—কিন্তু বাড়িটা এখন কার সম্পত্তি হবে? মালঞ্চর কোন ওয়ারশিন নেই?
—জানি না। এখনো তো দাবীদার আসেনি।
—হুঁ। কাল সকালে তুমি নটা নাগাদ আসতে পারবে?
–পারব না কেন, যাব।
—তাহলে ঐ কথাই রইল, আমি চলি।
কিরীটী থানা থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী চলন্ত গাড়িতে বসে বসে ভাবছিল—মালঞ্চর মৃত্যুটা কি তিনটি পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ঈর্ষা থেকেই ঘটেছে, না আরো কিছু ছিল?
সুরজিৎ ঘোষালের মত লোক ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে তার রক্ষিতাকে খুন করতে পারে কথাটা যেন ভাবা যায় না, অথচ তারই রুমাল মৃতের গলায় পেঁচিয়ে গিট বাঁধা ছিল, এবং সে মালঞ্চকে শাসিয়েছিল, হত্যার হুমকিও দেখিয়েছিল। সুরজিৎ ঘোষালকে গ্রেপ্তার করার পিছনে পুলিসের ঐটাই জোরালো যুক্তি, সুরজিৎ ঘোষালের কথাগুলো সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই জেনেছেন।
কিন্তু মানদা আরো বেশী কিছু জানে, কারণ সে ছিল মালঞ্চর পেয়ারের দাসী। অনেক মাইনে পেত সে। মানদা যদিও দীপ্তেন ভৌমিকের কথাটা স্বীকার করেনি তবু সে-ই তার মনিবের কর্ণগোচর করেছে বলে কিরীটীর ধারণা, সেটা মানদারই কাজ। মানদা গাছেরও খেতো তলারও কুড়াতে।
কিরীটীর আরো মনে হয় দীপ্তেন ভৌমিক সত্যি কথা বলেননি। কিরীটী জানত না যে দুদিন পরেই সে দীপ্তেন ভৌমিক সম্পর্কে এক চমকপ্রদ সংবাদ শুনবে সুশীল চক্রবর্তীর কাছ থেকে, এবং সে সংবাদ পাওয়ার পর মালঞ্চর হত্যা ব্যাপারটা সত্যিই জটিল হয়ে উঠবে।
» ০৯. পরের দিন সোয়া নটা নাগাদ
পরের দিন সোয়া নটা নাগাদ সুশীল চক্রবর্তী এসে হাজির হলেন কিরীটীর বাড়িতে।
কিরীটী প্রস্তুত হয়েই ছিল, সুশীল চক্রবর্তীর জীপে উঠে বসল।
হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির দরজায় দুজন সেপাই পাহারায় ছিল এবং একজন অন্দরে ছিল। জীপ থেকে সুশীল চক্রবর্তীকে নামতে দেখে তারা সেলাম জানাল। কিরীটীকে নিয়ে সুশীল চক্রবর্তী বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন।
প্রথমেই ওরা সুশান্ত মল্লিক যে ঘরটায় থাকে সেই নীচের ঘরটায় উঁকি দিলেন। সুশান্ত মল্লিককে ঘরের মধ্যে দেখা গেল না। ইতিমধ্যে জীপের শব্দে রতন ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। সুশীল চক্রবর্তী রতনকেই প্রশ্ন করলেন, সুশান্তবাবুকে দেখছি না, কোথায় তিনি?
—আজ্ঞে সকালে যখন চা দিই তখন তো ছিলেন। তবে গতকাল তিনি বলেছিলেন এ বাড়িতে তিনি আর থাকবেন না, চলে যাবেন।
-কেন, তার কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি?
—না বাবু অসুবিধা হবে কেন। মানদার হাতেই তো সংসার খরচের টাকা থাকত, এখন যা আছে এ মাসটা চলে যাবে। তবে ওনার তো আবার বোতলের ব্যাপার আছে। সন্ধ্যেবেলা—মানদা তো সে সব কিছু দিচ্ছে না। বোধ হয় সেইজন্যেই–
সুশীল চক্রবর্তী হাসলেন। ঠিক সেই সময় দেখা গেল সুশান্ত মল্লিক দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সুশীল চক্রবর্তীকে দেখে সুশান্ত বললে, এই যে দারোগাবাবু, আপনি আমার ওপরে কেন জুলুম করছেন বলুন তো?
-জুলুম?
–নয়? বাড়ি থেকে বেরুতে পারব না, এটা জুলুম ছাড়া আর কি বলুন তো?
কিরীটী চেয়ে চেয়ে দেখছিল লোকটাকে। মুখে বেশ দাড়ি গজিয়েছে খোঁচা খোঁচা। বোধ হয় কয়েকদিন কোন ক্ষৌরকর্ম না করায়। পরনের জামা ও পায়জামাটা ময়লা। একমাথা ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, মনে হয় অনেকদিন চিরুনির স্পর্শও পড়েনি।
কিরীটী চুপিচুপি সুশীল চক্রবর্তীকে বললে, এই বোধ হল মালঞ্চর স্বামী?
-হাঁ দাদা।
–লোকটাকে ছেড়ে দাও। তবে নজর রেখো-
-কিন্তু দাদা, যদি ভাগে, আমি তো ভেবেছিলাম এবারে ওকে অ্যারেস্ট করব। নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বললেন সুশীল।
–সুশান্তবাবু—
কিরীটীর ডাকে সুশান্ত মল্লিক তাকাল জাকুটি করে।
–আপনাকে আমরা ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারি, যদি ঠিক ঠিক আপনার কাছ থেকে যেগুলো জানবার জন্যে এসেছি সেগুলোর জবাব দেন।
-মানে আপনি সেদিন সে সব কথা বলেছেন, সব আমরা একেবারে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না। কিরীটীই জবাব দিল।
—আমি কিছু জানি না—বলতে বলতে কিছুক্ষণ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল সুশান্ত মল্লিক।
সুশীল চক্রবর্তী ঐ ঘরের দিকেই এগুচ্ছিলেন কিন্তু বাধা দিল কিরীটী। বললে, আগে চল সুশীল, বাড়িটা একবার ঘুরে দেখি, আর সেই ঘরটা
সুশীল চক্রবর্তী সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন, কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীর পিছনে এগোলেন। হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ল নীচের একটা তালাবন্ধ ঘরের বন্ধ জানলার দিকে—কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক, আর সেই সামান্য ফাঁকের মধ্যে দিয়ে উঁকি মারছে চোখ। সেই চোখের দৃষ্টিতে যেন তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি। কিরীটী থমকে দাঁড়াল।
কিরীটীকে থামতে দেখে সুশীল বললেন, কি হল দাদা, ওপরে চলুন—
–সুশীল, চল তো নীচের ঐ ঘরটা আগে দেখি। বলে বন্ধ দরজার ঘরটা কিরীটী দেখিয়ে দিল।
—ঐ তালাবন্ধ ঘরটা?
–হ্যাঁ। চাবি নেই তোমার কাছে?
–না তো।
—তাহলে ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায় পাওয়া যাবে?
ওদের কাছেই অল্প দূরে রতন দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে সুশীল চক্রবর্তী। শুধালেন, ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায়?
—তা তো জানি না হুজুর–
—ঐ ঘরে তালা দেওয়া কেন?
–তা জানি না হুজুর, ঐ ঘরটা তালা দেওয়াই থাকে, বরাবর–
—মানদাকে ডাকো তো, সে হয়তো জানে ঐ ঘরের তালার চাবি কোথায়।
ঠিক ঐ সময় মানদাকে দোতলার সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। রতন মানদাকে দেখতে পেয়ে বললে, বাবু, ঐ যে মানদা—