কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, তাই নাকি?
–হ্যাঁ, আজ দুদিন থেকে আপনার কথাই ভাবছিলাম দাদা।
—তাই বোধ হয় আমারও তোমার কথা মনে পড়ল। তা ব্যাপার কি বল তো, হিন্দুস্থান রোডের মার্ডার কেসটা না কি?
—হ্যাঁ দাদা—
—আমিও কিন্তু এসেছিলাম সেই ব্যাপারেই সুশীল।
-সত্যি! বসুন দাদা। তা আমাদের বড়কর্তাদের পক্ষ থেকে, না সুরজিৎ ঘোষালের পক্ষ থেকে?
–আপাতত বলতে পারো আমার নিজের পক্ষ থেকেই। এখনো কেসটা আমি কারো পক্ষ থেকেই নিইনি ভায়া।
–কেসটা কিন্তু বেশ জটিলই মনে হচ্ছে দাদা সুশীল চক্রবর্তী বললেন।
—সত্যিই জটিল কিনা সেটা জানবার জন্যই তো তোমার কাছে এসেছি ভায়া, তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে যা তোমার মনে হয়েছে বা হচ্ছে সেটা আমায় বল তো।
সুশীল চক্রবর্তী কিরীটীর অনুরোধে সেই প্রথম দিন থেকে মালঞ্চর হত্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা যা জেনেছেন একে একে সব বলে গেলেন এবং বলা শেষ করে বললেন, কি রকম মনে হচ্ছে দাদা ব্যাপারটা, সত্যিই কি বেশ একটু জটিলই নয়?
-খুব একটা জটিল বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না, ভায়া। কিরীটী বলল, আমি বুঝতে পারছি মালঞ্চ হত্যার বীজটা কোথায় ছিল—
—বুঝতে পারছেন?
–হ্যাঁ, তুমিও একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে। একটি নারীকে ঘিরে—যে নারীর মধ্যে মনে হয় তীব্র যৌন আকর্ষণ ছিল—এক ধরনের নারী, যারা সহজেই পুরুষের মনকে রিরংসায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে, সেইটাই এই হত্যার বীজ হয়ে ক্রমশ ডালপালা বিস্তার করেছিল বলেই আমার অনুমান।
—একটা বুঝিয়ে বলুন দাদা—সুশীল চক্রবর্তী বললেন।
—তিনটি পুরুষ এক্ষেত্রে—সুরজিৎ ঘোষাল ও দীপ্তেন ভৌমিক দুজনে বাইরের পুরুষ আর তৃতীয়জন মালঞ্চর হতভাগ্য স্বামী সুশান্ত মল্লিক ঘরের জন। মালঞ্চর যৌন আকর্ষণে ঐ তিনজন মালঞ্চকে ঘিরে ছিল।
—কিন্তু সুশান্ত মল্লিক তো তার স্ত্রীকে–
ভুলে যেও না, স্ত্রী ভ্ৰষ্টা হওয়া সত্ত্বেও সুশান্ত তার আকর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারেনি আর পারেনি বলেই তার স্ত্রী অন্যের রক্ষিতা জেনেও সেই স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি, হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতেই পড়ে ছিল। তার স্ত্রী অন্যের রক্ষিতা জেনেও তারই হাত থেকে প্রত্যহ মদের পয়সা ভিক্ষা করে নিয়েছে।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বলতে লাগল, তার স্ত্রী তার কাছে অপ্রাপণীয়া জেনেও তার মনের রিরংসা তাকে সর্বক্ষণ পীড়ন করেছে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এমনও তো হতে পারে ভায়া, সেই অবদমিত রিরংসা থেকেই কোন এক সময়ে একটা স্ফুলিঙ্গ তার মনের মধ্যে আকস্মিক আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং যার ফলে শেষ পর্যন্ত ঐ হত্যাকাণ্ডটা ঘটে গিয়েছে।
—কিন্তু যতদূর জানা গিয়েছে ঐ ব্যাপারের তিন দিন আগে থাকতেই সুশান্তবাবু ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল—সুশীল চক্রবর্তী বললেন।
-হা গিয়েছিল, কিন্তু হত্যার পরের দিনই তার প্রত্যাবর্তন। চলেই যদি গিয়েছিল তো আবার ফিরে এলো কেন? এবং ফিরে এলো যে রাত্রে হত্যাটা সংঘটিত হয় তারই পরদিন প্রত্যুষে। এর মধ্যে দুটো কারণ কি থাকতে পারে না?
–দুটো কারণ?
-হ্যাঁ, প্রথমত, যারা কোন বাসনা চরিতার্থ করবার জন্যে কাউকে হত্যা করে তাদের মধ্যে একটা সাইকোলজি থাকে, হত্যার আনন্দকে চরম আনন্দে তুলে দেবার জন্যে আবার তারা অকুস্থলে ফিরে আসে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সকলের মধ্যে উপস্থিত থেকে সেই চরম আনন্দকে রসিয়ে রসিয়ে উপলব্ধি করবার জন্যে। এবং দ্বিতীয়ত, সুশান্ত মল্লিক হয়তো অকুস্থল থেকে ঘটনার সময় দূরে থেকে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে তার নির্দোষিতাটুকুই, an alibi.
সুশীল চক্রবর্তী বললেন, আমি দাদা অতটা–
–তলিয়ে দেখনি, তাই না ভায়া, কিন্তু কথাটা ভাবা উচিত ছিল না কি তোমার?
–ভাবছি আপনি বুঝলেন কি করে যে সুশান্ত মল্লিককে আমি সত্যি কিছুটা eliminate করেছিলাম–
–সে তো তোমার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি যত গুরুত্ব দিয়েছ ঐ দুজনের ওপরেই—সুরজিৎ ঘোষাল আর দীপ্তেন ভৌমিক। কিন্তু খুনের মামলার তদন্তে অমন বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যাপারটা তোমার অবহেলা করা উচিত হয়নি।
-কোন্ ব্যাপারটার কথা বলছেন?
–ঐ যে তোমার ঐ সুশান্ত মল্লিকের হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে অকুস্থলে আবির্ভাব ও তার সেই কথাগুলো—দরজা আর খুলবে না, রতন আর মানদা যখন কিছুতেই দরজা খোলাতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটা সে বলল কেন? এমনি একটা কথার কথানা কি জেনেশুনেই সে মালঞ্চর মৃত্যুর ব্যাপারটা ঘোষণা করেছিল? যাকগে, rather late than never—তুমি দীপ্তেন ভৌমিকের সঙ্গে কথা বলেছ?
—বলেছি, গত পরশুই তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে তো কাছাকাছিই। লেক রোডে থাকে, কিন্তু দেখা পাইনি। অফিসের কাজে নাকি তিনি আগের দিন পাটনায় গিয়েছেন আর আজকালের মধ্যেই তার ফেরার কথা। বলে এসেছি এলেই থানায় রিপোর্ট করতে–
ঐ সময়ে থানার সামনে একটা গাড়ি এসে থামার শব্দ পাওয়া গেল এবং একটু পরেই। একজন সুশ্রী ভদ্রলোক এসে ঘরে ঢুকলেন।
—কি চাই? সুশীল চক্রবর্তীহ প্রশ্ন করলেন।
—এখানকার ও. সি.-কে।
—আমিই–বলুন কি দরকার?
—আমার নাম দীপ্তেন ভৌমিক।
নাম কানে যেতেই কিরীটী দীপ্তেন ভৌমিকের দিকে তাকিয়ে দেখল। বেশ বলিষ্ঠ লম্বা চওড়া চেহারা, সুশ্রীও।
–বসুন মিঃ ভৌমিক–সুশীল চক্রবর্তী বললেন।