—আপনি যদি একবার অনুরোধ করেন মিঃ ভাদুড়ী—যুধাজিৎ বলল। সোমনাথ ভাদুড়ী প্রত্যুত্তরে যুধাজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমিই যখন তার নাম করেছি তখন আমি অবশ্যই বলব।
—তাহলে আর দেরি করে লাভ কি, চলুন না এখনই একবার তার কাছে যাই
—এখন না, কাল বিকেলের দিকে আসুন, যাওয়া যাবে। সকালটা আমায় জামিনের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতে হবে।
নির্মল বসু বললেন, মিঃ ভাদুড়ী, আমিও কি আসব?
—আসতে পারেন, তবে না এলেও চলে, আমিই যুধাজিৎবাবুকে নিয়ে যাব।
—তাহলে সেই কথাই রইল, আমি না এলে যুধাজিৎবাবুই আসবেন। আজ উঠি—
পরদিন আদালতে পুলিস সুরজিৎ ঘোষালকে হাজির করল।
কিন্তু সংবাদপত্রের রিপোর্টাররা কি করে জানি সংবাদটা ঠিক পেয়ে গিয়েছিল, ঐদিনকার সংবাদপত্রে সুরজিৎ ঘোষালের গ্রেপ্তারের কাহিনী ছাপা হয়ে গিয়েছে দেখা গেল। সারা কলকাতা শহরে যেন একটা সাড়া পড়ে যায়। এত বড় একজন মানী লোক,—জনসাধারণের কৌতূহল যেন সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আদালতে কিন্তু জামিন পাওয়া গেল না, সরকার পক্ষের কৌঁসুলি মিঃ চট্টরাজ তীব্র ভাষায় জামিন দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করলেন।
সোমনাথ ভাদুড়ী যদিও বললেন, তার ক্লায়েন্ট সমাজের একজন গণমান্য ও প্রতিষ্ঠিত লোক, তাকে জামিনে খালাস দেওয়া উচিত। কিন্তু তার উত্তরে চট্টরাজ বললেন, জামিন দিলে তদন্তের অসুবিধা হবে, চার্জ গঠন করা যাবে না।
জজসাহেব উভয়পক্ষের সওয়াল শুনে সুরজিৎকে আরো দশদিন হাজতে থাকবার নির্দেশ দিলেন। আরো দশদিন পরে ধার্য হল শুনানির দিন, পুলিসের তদন্তের সাহায্য করবার জন্য।
বলাই বাহুল্য, পরের দিনের সংবাদপত্রে সমস্ত ব্যাপারটা বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়ে গেল। সুরজিৎ ঘোষালকে জামিন দেননি জজ, আরো তদন্ত সাপেক্ষে জেল হাজতে থাকবার হুকুম দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া গ্রাস করল সুরজিৎ ঘোষালের গৃহকে।
০৭. কিরীটী প্রথমটা রাজী হয়নি
রাত আটটা নাগাদ সোমনাথ ভাদুড়ী তার গড়িয়াহাটার বাড়িতে একাই এসেছিলেন কিরীটীর সঙ্গে দেখা করতে। কিরীটী বলেছিল, না ভাদুড়ীমশাই, ওসব ঘাঁটাঘাঁটি করতে এ বয়সে আর ভাল লাগে না, আপনারা বরং সুব্রতর কাছে যান। আমার মনে হয় সে কেসটা ঠিক ট্যাক্স করতে পারবে।
—তা জানি, মৃদু হেসে সোমনাথ বললেন, তবু কিরীটীবাবু আপনি হলে—
—আমিও বিশ্বাস করি অ্যাড়ভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ী যখন এ মামলা হাতে নিয়েছেন তখন কোন অবিচার হবে না, দোষী ঠিকই চিহ্নিত হবে।
হাসতে হাসতে সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন, কিন্তু আপনি ছাড়া মামলার সমস্ত সূত্র গুছিয়ে আমার হাতে তুলে দেবে কে কারণ ব্যাপারটা সত্যিই আমার কাছে জটিল মনে হচ্ছে রায়মশাই। তাছাড়া সুরজিৎ ঘোষাল সমাজের একজন গণমান্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। অবিশ্যি রক্ষিতার ব্যাপারটা তার জীবনে একটা কলঙ্ক। কিন্তু আজকের দিনে হাতে যাদের প্রয়োজনের বেশী পয়সা আছে, প্রায়ই তাদের মধ্যে ঐ ধরনের দখা দেয়।
কিরীটী এবারে হেসে উঠল।
—হাসছেন রায়মশাই, আমার ঐসব সো-কলড় হাই সোসাইটির কিছু কিছু ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার কিছু কিছু ব্যাপার-স্যাপার জানবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই বলুন হয়েছে, এমন demoralised হয়ে গেছে সব
আস্তে ভাদুড়ী মশাই, আস্তে। কিরীটী পূর্ববৎ হাসতে হাসতেই বলল, আপনি যাঁদের কথা বলছেন তারা ওই সব ব্যাপারকে কোন ব্যাধি, পাপ বা অন্যায় কিছু বলে মনে করেন না। তাছাড়া ওটা এ যুগের একটা কালচারের সামিল।
-কালচারই বটে। সে যাক, আপনাকে কিন্তু সুরজিৎ ঘোষালের কেসটা হাতে নিতে হবে।
—আপনার কাছ থেকে রেহাই পাবো না বুঝতে পেরেছি, বলুন সব ব্যাপারটা–আপনি যতদূর জানেন।
সোমনাথ ভাদুড়ী বলে গেলেন সব কথা। কিরীটী নিঃশব্দে শুনে গেল, কোন মন্তব্য। করল না। সোমনাথ ভাদুড়ীর কথা শেষ হলে পাইপে টোবাকো ঠাসতে ঠাসতে কিরীটী বলল, তাহলে এখানেও সেই এক নারী ও তিনটি পুরুষের সংযোজন। ট্রায়াঙ্গুলার ব্যাপার। মালঞ্চ দেবীর স্বামী সুশান্ত মল্লিক আর দুজন-সুরজিৎ ঘোষাল ও দীপ্তেন ভৌমিক। তিনজনই চাইত এক নারীকে। সুশান্ত মল্লিক মানে ঐ মালঞ্চর স্বামীটা তো একটা ফুল—নচেৎ স্ত্রীকে একজনের রক্ষিতা হিসাবে allow করে সেই রক্ষিতার আশ্রয়েই থাকতে পারে। তার পয়সায় নেশা করতে পারে! কে জানে, হয়তো সে সত্যি সত্যিই মালঞ্চকে ভালবাসত
–ভালবাসত! না না, ও একটা অপদার্থ।
—তবু তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন না ভাদুড়ীমশাই, এবং বর্তমান মামলায় যে মোটিভ বা উদ্দেশ্য সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেটা ওর দিক থেকে বেশ strong থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যেক হত্যার ব্যাপারেই আপনি তো জানেন আমাদের সর্বাগ্রে তিনটি কথা চিন্তা করতে হয়। প্রথমত, হত্যার উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়ত, এক বা একাধিক ব্যক্তি সেই হত্যার আশেপাশে থাকলে হত্যা করার ব্যাপারে কার কতটুকু possibility বা সম্ভাবনা থাকতে পারে ও তৃতীয়ত, probability, ওদের মধ্যে কার পক্ষে হত্যা করার সবচাইতে বেশী সুযোগ ছিল।
—তাহলে তো রায়মশাই ওদের তিনজনই
—সেইজন্যেই তো বলছিলাম ভাদুড়ীমশাই, যে বাড়িতে হত্যা সংঘটিত হয়েছে ওদের তিনজনের মধ্যে একজন সেখানে থাকত ও অন্য দুজনের সেখানে সর্বদা যাতায়াত ছিল। কাজেই ওদের তিনজনেরই মালঞ্চকে হত্যা করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল বলে ওদের যে কোন একজনের পক্ষে হত্যা করা সম্ভবও ছিল। আর এই মামলায় আপনার সর্বাপেক্ষা বড় সূত্র এইটিই হবে, তাই সর্বাগ্রে আপনাকে ঐ তিনটি মহাপুরুষের সমস্ত সংবাদ in details সংগ্রহ করতে হবে।