.
ড্রয়ারের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের বাক্সের মধ্যে একগাদা একশো টাকার নোট বাণ্ডিল বাঁধা, কিছু দশ টাকা ও পাঁচ টাকার নোট, খুচরো পয়সা। আন্দাজে মনে হল একশো টাকার নোট প্রায় হাজার দুই টাকার হবে। আলমারিটা বন্ধ করে, ঘরে ইয়েল-লক্ টেনে দিয়ে চাবিটা সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এলেন সুশীল চক্রবর্তী।
বাইরে মানদা দাঁড়িয়ে ছিল। মানদাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই চাবি কি তোমার মার কাছেই থাকত?
—আজ্ঞে একটা চাবি বাবুর কাছে আর অন্যটা মার কাছে থাকত, মানদা বলল।
—সদরের চাবি তো তাহলে তার কাছেও একটা থাকত?
—হ্যাঁ।
অতঃপর বিক্রম সিংকে বাড়ির প্রহরায় রেখে বাইরে এসে জীপে উঠে বসলেন সুশীল চক্রবর্তী। আসবার সময় আর একবার উঁকি দিলেন নীচের তলায় সুশান্ত মল্লিকের ঘরে-সুশান্ত মল্লিক ঘুমোচ্ছে।
আকাশ কালো হয়ে উঠেছে তখন। গতরাত থেকেই মধ্যে মধ্যে মেঘ জমেছে আকাশে কিন্তু বৃষ্টি নামেনি। পথে যেতে যেতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
সুরজিৎবাবুর বড় ছেলে যুধাজিৎ পরের দিন তার মার কাছ থেকেই সব ব্যাপারটা জেনেছিল। স্বামীর যে একটা রক্ষিতা আছে, আর তাকে বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছেন সুরজিৎ তাঁর স্ত্রী স্বর্ণলতা জানতেন। প্রথম প্রথম স্বামীকে ফেরাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন স্বর্ণলতা, অনেক কান্নাকাটিও করেছিলেন, কিন্তু স্বামীকে ঐ ডাইনীর কবল থেকে উদ্ধার করতে পারেননি। অবশেষে চুপ করে গিয়েছিলেন।
ঐ দিন সুরজিৎবাবু ফিরতেই স্বর্ণলতা শুধালেন, কোথায় গিয়েছিলে এই সাত সকালে?
–কাজ ছিল?
—কি এমন কাজ যে ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটেছিলে গাড়ি নিয়ে?
—মালঞ্চকে কে যেন খুন করে গিয়েছে-
-সে কি! অস্ফুট একটা আর্তনাদ স্বর্ণলতার কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এলো।
—হ্যাঁ। থানার লোক এসে দরজা ভেঙে তাকে মৃত অবস্থায় দেখেছে।
–তা কি ভাবে মারা গেল গো?
—গলায় রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
–কি সর্বনাশ! কে–কে করল?
–তা আমি কি করে বলব?
—তুমি জানো না কিছু? প্রশ্নটা করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন স্বর্ণলতা–সত্যি সত্যিই তুমি জানো না?
স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে তাকালেন সুরজিৎ। কয়েকটা মুহূর্ত স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তারপর শান্ত গলায় স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে সুরজিৎ বললেন, কি বলতে চাও তুমি?
–তুমি তো কাল রাত্রেও সেখানে গিয়েছিলে?
—তাই কি? স্পষ্ট করে বল, কি বলতে চাও তুমি?
—তুমি কিছুই জানো না?
—কি জানব?
—কে তাকে হত্যা করল?
–জানি না।
–জানো না? তাহলে কাল অত রাত করে বাড়ি ফিরেছিলে কেন?
০৬. হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির দোতলা
শনিবার সকালে হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির দোতলার দরজা ভেঙে মালঞ্চর মৃতদেহ পুলিস আবিষ্কার করল এবং পরের শুক্রবার মানে ঠিক পাঁচদিন পরে যেন সমস্ত ব্যাপারটা নাটকীয় একটা মোড় নিল। সুরজিৎ ঘোষাল যা স্বপ্নেও ভাবেননি তাই হল। সংবাদপত্র ব্যাপারটা ফ্লাশ করল।
বালিগঞ্জ হিন্দুস্থান রোডের এক দ্বিতল গৃহে, রুমালের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক মহিলাকে। শোনা যাচ্ছে ঐ মহিলাটি কোন একটা নামকরা ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের নাকি রক্ষিতা ছিল। সেই রক্ষিতাকে ভদ্রলোকটি ওই বাড়িটি কিনে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক নিয়মিত সন্ধ্যায় ঐ রক্ষিতার গৃহে যেতেন এবং রাত্রি এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি থেকে আবার চলে আসতেন।
পুলিস বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে যে যেদিন রাত্রে হত্যা সংঘটিত হয়, সেই দিন সন্ধ্যায়ও অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যাতেও ঐ ভদ্রলোক তার গৃহে গিয়েছিলেন। পুলিস জোর তদন্ত চালাচ্ছে। ঘরের মেঝেতে একটি বহুমূল্য মুক্তোর মালা ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া। গিয়েছে। আরো সংবাদ যে, যে রুমালের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে ওই স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করা হয়েছে সেই রুমালের এক কোণে নাকি লাল সুতোয় ইংরেজী আদ্যক্ষরে S লেখা আছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আগের দিন সন্ধ্যার কিছু পরে, অর্থাৎ সোমবার সুশীল চক্রবর্তী এসেছিলেন পার্ক স্ট্রীটে সুরজিৎ ঘোষালের গৃহে।
সুরজিৎ ঘোষাল সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন তখন। জামা কাপড়ও ছাড়েননি। ভৃত্য সনাতন এসে জানাল, বালিগঞ্জ থানার ও.সি. সুশীলবাবু দেখা করতে এসেছেন।
সুশীল চক্রবর্তী। চমকে ওঠেন সুরজিৎ।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী স্বর্ণলতা। তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালেন, বালিগঞ্জ থানার ও. সি. আবার কেন এলো গো?
—কি করে জানব! দেখি—সুরজিৎ ঘোষাল উঠে পড়লেন।
নীচের পার্লারে সুশীল চক্রবর্তী অপেক্ষা করছিলেন। সুরজিৎ ঘোষাল নীচে এসে পার্লারে প্রবেশ করলেন।
—মিঃ ঘোষাল, এ সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি সত্যই দুঃখিত।
–কি ব্যাপার মিঃ চক্রবর্তী?
—এই রুমালটা দেখুন তো–বলে কাগজে মোড়া একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে সুরজিৎ ঘোষালের সামনে ধরলেন সুশীল চক্রবর্তী।
–রুমাল! কেমন যেন অসহায় ভাবে কাগজের মোড়কটার দিকে তাকালেন সুরজিৎ ঘোষাল!
—এই রুমালটার সাহায্যেই সেদিন মালঞ্চ মল্লিককে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল! দেখুন তো, এই রুমালটা চিনতে পারেন কি না—
সুরজিৎ ঘোষালের সমস্ত দেহটা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। মুখে একটিও কথা নেই। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি রুমালটার দিকে। রুমালটার এক কোণে লাল সুতো দিয়েই ইংরেজী S লেখা।