—তোমার ধারণা তাহলে দীপ্তেনবাবুর ব্যাপার নিয়েই —ঠিক জানি না বাবু, তবে আমার তো তাই মনে হয়।
—হুঁ। ঠিক আছে, যাও। মানদাকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও। আর শোন, এখন এ বাড়িতে পাহারা থাকবে, তুমি কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না।
-আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলাম আজই দেশে চলে যাব।
-না, এখন তোমার যাওয়া হবে না। পালাবার চেষ্টা করলে কিন্তু বিপদে পড়বে-বুঝেছ? যাও, মানদাকে পাঠিয়ে দাও–
মানদা এলো।
আর একবার মানদার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলেন সুশীল চক্রবর্তী, তারপর জেরা শুরু করলেন।
—মানদা, কাল তোমার সুরজিৎবাবু কখন এখানে আসেন?
—তা ঠিক বলতে পারব না বাবু, ঘড়ি দেখিনি। তবে দীপ্তেনবাবু আসার ঘণ্টাখানেক পরেই বাবুর গাড়ি এসে থামে।
–দীপ্তেনবাবু তখন কোথায় ছিলেন?
-এই ঘরে।–তাহলে তোমার বাবুর সঙ্গে দীপ্তেনবাবুর কাল রাত্রে দেখা হয়েছিল বল?
–তা বলতে পারব না বাবু।
–কেন, দীপ্তেনবাবু তো তখন এই ঘরেই ছিলেন বলছ!
—ছিলেন, তবে দেখা হয়েছিল কিনা জানি না। কারণ পরে বাবু চেঁচামিচি করে যখন বের হয়ে গেলেন তখন ঘরে ঢুকে আমি দীপ্তেনবাবুকে দেখতে পাইনি।
–এ বাড়ি থেকে বেরুবার আর কোন দ্বিতীয় রাস্তা আছে?
—না তো।
—বলছিলে বাবু চেঁচামেচি করছিলেন—কেন চেঁচামেচি করছিলেন তা জানো?
–বোধ হয় ঐ দীপ্তেনবাবুর ব্যাপার নিয়েই–
-দীপ্তেনবাবু যে তোমার বাবুর অনুপস্থিতিতে এই বাড়িতে আসতেন তোমার বাবু জানলেন কি করে—তুমি বলেছিলে?
—আজ্ঞে না। মা আমাকে মানা করে দিয়েছিলেন, আমি বলতে যাব কেন?
–মিথ্যে কথা। সত্যি বল, তুমিই–মা কালীর দিব্বি বাবু, আমি চুকলি কাটিনি।
–তুমি মাইনে কত পেতে?
–দেড়শো টাকা।
–বল কি! তা মাইনেটা কে দিত?
–মা-ই দিতেন।
–হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পারো। আর একটা কথা শুনে রাখ, এ বাড়ি থেকে এখন তুমি বা রতন কেউ কোথাও বেরুবে না।
-বেশ, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
–ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।
মানদা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
০৫. মালঞ্চর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা
মালঞ্চর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন সুশীল চক্রবর্তী, ঐখান থেকেই ফোন করলেন।
মৃতদেহের ব্যবস্থা করে সুশীল চক্রবর্তী ঘরটা আর একবার ভালো করে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন।
বেশ বড় সাইজের ঘর, মেঝেতে সুন্দর ডিজাইনের টালি পাতা। একধারে একটি খাটো মোটা ডানলোপিলোর গদির ওপর বিছানা পাতা। দামী একটা বেডকভার দিয়ে তখনো শয্যাটি ঢাকা, বোঝা যায় গতরাত্রে ঐ শয্যা কেউ ব্যবহার করেনি।
একধারে একটা স্টীলের আলমারি, তারই গা ঘেঁষে বিরাট একটা ড্রেসিং টেবিল তার সামনে বসবার একটা গদি-মোড়া কুশন। ড্রেসিং টেবিলের ওপর নানাবিধ দামী দামী প্রসাধন দ্রব্য সাজানো। সবই ফরেন গুডস্। প্রসাধন দ্রব্যগুলো দেখলে মনে হয় মালঞ্চ রীতিমত শৌখিন ছিল।
ঘরে অন্যদিকে একটা ওয়ারড্রোব, তার ওপরে সুন্দর সোনালী ফ্রেমে পাশাপাশি দুটো ফটোই বোধ হয় একসময় ছিল, এখন একটাই মাত্র দেখা যাচ্ছে–মালঞ্চর ফটো।
ফটো-ফ্রেমের সামনে একগোছা চাবিসমেত একটা রুপোর চাবির রিং, এবং তার পাশে রয়েছে একটা দামী লেডিজ রিস্টওয়াচ। ঘড়িটা তখনও চলছে।
ঘরের অন্য কোন সুদৃশ্য জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে একগোছা বাসী রজনীগন্ধার স্টিক। তার পাশে একটা মাঝারি সাইজের রেডিওগ্রাম।
ঘরটা দেখা শেষ করে সুশীল চক্রবর্তী ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজা ঠেলে বাথরুমে প্রবেশ করলেন।
দীপ্তেন ভৌমিক কাল সন্ধ্যায় এখানে এসেছিল, কিন্তু তাকে রতন বা মানদা কেউই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেনি। তবে কোথা দিয়ে লোকটা বের হয়ে গেল কাল রাত্রে? প্রশ্নটা সুশীল চক্রবর্তীর মাথার মধ্যে তখনো ঘোরাফেরা করছে।
ঘরের দরজায় ইয়েল-লক্ করা ছিল, সেই দরজা ভেঙে এঁরা ঢুকেছেন মালঞ্চর শোবার ঘরে। বাথরুমে দেখা গেল আর একটা দরজা আছে কিন্তু সে দরজাটা বন্ধ। সুশীল চক্রবর্তী আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন এ বাড়িতে ঢোকার সময়—সদরের দরজাতেও ইয়েল-লক্ সিস্টেম।
বাথরুমের দরজা বন্ধ, ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল। তবে কোথা দিয়ে কোন্ পথে দীপ্তেন ভৌমিক এ বাড়ি থেকে গত রাত্রে বের হয়ে গিয়েছিল। তবে কি সকলের অজ্ঞাতে এক সময় ঐ সদর দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিল?
বাথরুমে দেখবার বিশেষ কিছু ছিল না, ঝকঝকে আয়না লাগানো, বেসিন, ব্র্যাকেটের সঙ্গে লিকুইড সোপ কেস লাগানো, গোটা দুই টুথব্রাশ, টুথ পেস্ট, একটা ট্যালকম পাউডারের কৌটো, সাবানের কেস, তাতে সাবান রয়েছে। দেওয়ালের র্যাকে ঝুলছে একটা টাওলে আর সিল্কের নাইটি।
বাথরুমের পিছনের দরজাটা খুলে ফেললেন সুশীল চক্রবর্তী। একটা ঘোরালো লোহার সিঁড়ি নীচের গলিপথে নেমে গিয়েছে। মেথরদের যাতায়াতের ব্যবস্থায় ঐ সিঁড়ি। দরজাটা বন্ধ করে সুশীল চক্রবর্তী আবার ঘরে ফিরে এলেন।
মর্গে বডি নিয়ে যাবার জন্য একটা কালো ভ্যান এসে গিয়েছে।
ডেড-বড়ি নিয়ে যাবার পর সুশীল চক্রবর্তী ঘরের মধ্যেকার আলমারিটা খুললেন–ঐ চাবির রিংয়ের একটা চাবির সাহায্যে।
হ্যাঙারে নানা রঙের সব দামী দামী শাড়ি ও ব্লাউজ সাজানো। চাবি দিয়ে আলমারির ড্রয়ার খুললেন—একটা চন্দন কাঠের বাক্স–বেশ ভারী—তালা লাগানো ছিল না বাক্সটায়, ডালা তুলতেই দেখা গেল অনেক সোনার গহনা—ডালা বন্ধ করে বাক্সটা আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন।