- বইয়ের নামঃ নগরনটী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. আজকাল আর সুরজিৎ সন্ধ্যার কিছু পরেই
আজকাল আর সুরজিৎ সন্ধ্যার কিছু পরেই ঠিক বাঁধা টাইমে আসছে না—আগে তো নয়ই বরং আধ ঘণ্টা তিন কোয়ার্টার কখনো কখনো এক ঘণ্টা পরেও আসে। তবে আসে ঠিকই। একদিনও আসা তার বাদ যায় না।
আর সেই কারণেই সন্ধ্যা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মালঞ্চকে প্রস্তুত হয়েই থাকতে হয়–এই সময়টা কোথাও সে বেরুতে পারে না।
মালঞ্চ শোবার ঘরে বড় আয়নাটার সামনে একটা ছোট টুলের উপর বসে সাদা হাতীর দাঁতের চিরুনিটা দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল।
দীর্ঘ কেশ মালঞ্চর। এত দীর্ঘ যে কোমর ছাড়িয়ে যায়। একসময় কেশের দৈর্ঘ্য তার আরো বেশী ছিল—এখন অনেকটা কম। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অন্যমনস্কভাবে মালঞ্চ সামনের মসৃণ আরশির গায়ে প্রতিফলিত তার নিজের চেহারাটার দিকে তাকাচ্ছিল।
নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে ভাল লাগে বেশ মালঞ্চর, বয়স তার যা-ই হোক—দেহের বাঁধুনি আজও তার বেশ আঁটসাঁটই আছে। গালে ও কপালে অবিশ্যি দুচারটে বক্ররেখা পড়েছে, তা সেগুলো ফেস্ ক্রিমের প্রলেপ পড়লে চট করে তেমন ধরা যায় না। মালঞ্চ অবিশ্যি বুঝতে পারে, তার বয়স হচ্ছে আর সেই কারণেই বোধ হয় নিজের দেহচর্চা সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ থাকে।
কিছুক্ষণ আগে শহরের বুকে সন্ধ্যা নেমেছে তার ধূসর আঁচলখানি বিছিয়ে। জুন মাস শেষ হতে চলল–এখনও বৃষ্টির চিহ্নই নেই। সারাটা দিন ভ্যাপসা গরম। দুপুরে এখানে ওখানে খানিকটা মেঘ জমেছিল, মনে হয়েছিল বুঝি বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি নামতে পারে, কিন্তু নামল না।
সুরজিতের আজকাল আসার কোন সঠিক নির্দিষ্ট সময় নেই, তাহলেও সে আসবেই একবার, আর সেই কারণেই প্রতি সন্ধ্যায় মালঞ্চকে সেজেগুজে প্রসাধন করে প্রস্তুত থাকতে হয়।
অনেক সময় মালঞ্চর নিজেকে যেন কেমন ক্লান্ত লাগে।
আজকাল কিছুদিন ধরে মালঞ্চ যেন লক্ষ্য করছে সুরজিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন। কেমন যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর মনে হচ্ছে—বালিগঞ্জের বনেদী পাড়ায় দোতলার একটা ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলের মধ্যে সাদা হাতীর দাঁতের চিরুনিটা চালাতে চালাতে ভাবছিল মালঞ্চ। একঝলক মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিল মালঞ্চর।
মালঞ্চর বুঝতে কষ্ট হয় না, ওটা বেলফুলের গন্ধ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভীরু গলায় ডাক ভেসে এলো পশ্চাৎ থেকে মালা!
মালঞ্চ গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে কার গলা। মালঞ্চ ফিরেও তাকাল না। যেমন চিরুনিটা দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল তেমনি আপন মনে আঁচড়াতেই লাগল।
মালা! আবার সেই ভীরু ডাক।
এবারও মালঞ্চ ফিরে তাকাল না এবং আগের মতই আরশির সামনে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে সাড়া দিল, কি চাই?
যে লোকটি একটু আগে হাতে একটা বেলফুলের মালা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সে এবার কুণ্ঠিত ভাবে বললে, খুব ব্যস্ত, না?
না, বল কি বলবে? মালঞ্চ বললে।
তোমার জন্যে একটা বেলফুলের মালা এনেছি, গলায় পরবে!
পিছনে ফিরে না তাকিয়েই মালঞ্চ নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, রেখে যাও ঘরের মধ্যে।
কোন সাড়া এলো না অন্য দিক থেকে।
দরজার ওপরেই দাঁড়িয়ে লোকটি, বয়স ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। সমস্ত শরীরটাই মানুষটার কেমন বুড়িয়ে গিয়েছে, চুলে পাক ধরেছে। ভাঙা গাল, সরু চোয়াল, কোটরগত দুটি চক্ষু! পরিধানে একটা ময়লা পায়জামা, গায়ে একটা হাফ-হাতা সস্তা দামের শার্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দুতিন দিন বোধ হয় লোকটা ক্ষৌরকর্ম করে নি।
লোকটা নিঃশব্দে অল্পদূরে দাঁড়িয়েই আছে।
কি হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন। মালঞ্চ বলল, বললাম তো মালাটা ঘরে রেখে যাও।
দাও না গলায় মালাটা, মোড় থেকে দু টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে এলাম!
কে বলেছিল তোমাকে দুটাকা খরচ করে বেলফুলের মালা আনতে?
কেউ বলেনি, আমারও তো ইচ্ছা যায়—
তাই নাকি! ফিরে তাকাল মালঞ্চ এতক্ষণে।
হ্যাঁ, তাছাড়া সে-সব দিনগুলো ভুলতে পারি কই, রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্যে এমন দিনে মালা নিয়ে আসতাম, তুমি খোঁপায় জড়াতে।
দেখ সুশান্ত, বাজে কথা রেখে তোমার আসল কথাটা খুলে বল তো এবার।
আসল কথা আবার কি—সুশান্ত মৃদু গলায় বলল।
কি ভাবো তুমি যে, আমি এতই বোকা, কিছু বুঝি না?
নির্লজ্জর মত হাসতে থাকে সুশান্ত।
বোকার মত হেসো না, তোমার ঐ হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে যায়-ঘেন্না করে—ভনিতা রেখে আসল কথাটা বলে ফেল।
সুশান্ত কোন জবাব দেয় না।
আমি জানি তুমি কেন এসেছ, কেন ঐ মালা এনেছ।
কেন?
টাকা চাই, তাই না?
না, মানে—
পরশু চল্লিশ টাকা দিলাম, এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল? আমার আজ স্পষ্ট কথা, টাকা তুমি পাবে না।
পাবো না! কেমন যেন একটা করুণ আর্তি সুশান্তর কণ্ঠে বেজে উঠল। হাসিটা নিভে গেল।
না, তোমার মদের খরচা রোজ রোজ আমি দিতে পারব না। লজ্জা করে না। তোমার, এ বাড়িতে নিচের তলায় চাকরের মত পড়ে আছ, আর একজনের দুমুঠো কৃপার অন্নে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছ, গলায় দড়ি জোটে না তোমার
দড়ি জুটলে সে দড়ি গলায় দেবার সাহস হত না—তা না হলে সুরজিতের। রক্ষিতার কাছে আমি হাত পাতি—
ঘেন্না পিত্তি বলে একটা সাধারণ বস্তু, যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, তাও কি তোমার নেই?
সব—সবই ছিল মালা, ঐ যে তোমার ঘেন্না, পিত্তি, লজ্জা, সবই ছিল কিন্তু তুমিই আমার বস্ত্রহরণ করেছ—