লাভ! লাভ time-factor! কিরীটী হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দিল।
১০. কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ
কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ হয়ে আত্মগত চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে এবং আবার এক সময় ডাঃ সানিয়ালই প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায় যে গত রাত্রে মিস সুলতা করকে নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ কফির সঙ্গে ইচ্ছে করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করেছিল!
বলাই বাহুল্য। অন্যথায় তার উপস্থিতিতে মিঃ চৌধুরীকে ওভাবে হত্যা করা তত সম্ভবপর হত না।
I see! আচ্ছা মিঃ রায়, আপনার কি তাহলে মনে হয় মিস সুলতা কর এই হত্যার ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে?
ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে কিনা জানি না তবে হত্যার সময়টিতে সে অকুস্থানে উপস্থিত ছিল সেটাই যে সব চাইতে বড় কথা এখন।
কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই ডাক্তার—তবে হ্যাঁ, She was in deep sleep হত্যার সময়টিতে এটা ঠিকই।
অতঃপর ডাঃ সানিয়াল যেন বলবার মত কোন কথাই আর খুঁজে পান না। এবং কিরীটীও নিঃশব্দে বসেই ধূমপান করতে করতে পীতাভ ধোঁয়া উদগীরণ করতে থাকে।
সহসা একসময় যেন চিন্তাগ্রস্ত মনটাকে একটা নাড়া দিয়ে চুরুটের অগ্রভাগ হতে ভস্মাবশেষ ছাইটা আঙুলের টোকা দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে, ডাক্তার, আপনার পরামর্শটা ভেবে দেখলাম মন্দ নয়—আর একবার বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? আপনি গিয়ে একটিবার মিস করকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাকে আবার cross করে না হয় দেখা যাক।
নিশ্চয়ই, এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ডাঃ সানিয়াল ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
.
দশ-পনের মিনিট পরেই বাইরে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল এবং বোঝা গেল পদশব্দ এগিয়ে আসছে এবং পদশব্দ ঘরের বাইরে বদ্ধ দরজার সামনে এসে থামল।
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী আহ্বান জানায়, আসুন সুলতা দেবী। দরজা খোলাই আছে।
সত্যি সুলতাই। সুলতা দরজা ঠেলে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটী চেয়ারটার উপরে সোজা হয়ে বসে একটু নড়েচড়ে।
সুলতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে মুহূর্তের জন্য একবার কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল এবং কিরীটীর স্থির নিষ্কম্প দুই চোখের শান্ত দৃষ্টির সঙ্গে বারেকের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সে মুখখানি অবনত করে ভূমিতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
কয়েক মুহূর্ত ঘরের মধ্যে যেন একটা বিশ্রী স্তব্ধতা থমথম করতে থাকে।
কিরীটীই পুনরায় আড়চোখে সুলতার সর্বাঙ্গে বারেকের জন্য তার দুই চক্ষুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুলতার সমগ্র মুখখানিতে দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বসুন সুলতা দেবী, ঐ চেয়ারটায় বসুন। স্নিগ্ধ কণ্ঠে কিরীটী সুলতাকে বলে কথাগুলো। সুলতা কিরীটীর নির্দেশে সামনের শূন্য চেয়ারটা একটু ঠেলে নিয়ে বসল।
কিরীটী লক্ষ্য করে, সামনাসামনি চেয়ারে বসলেও সুলতা যেন তার দিকে চোখ তুলে চাইছে না।
কিরীটী সুলতার দিকেই চেয়ে ছিল।
দু হাত তার চেয়ারের দুদিককার হাতলের ওপরে ন্যস্ত। দু হাতের দশ আঙুলের সাহায্যে সে চেয়ারের হাতল দুটো যেন চেপে ধরেছে।
কিরীটী নিঃশব্দে পূর্ববৎ ধূমপান করতে থাকে।
অদূরে টেবিলের উপর রক্ষিত টাইমপিসটা কেবল ঘরের নিস্তব্ধতা একঘেয়ে টিক টিক শব্দ তুলে ভঙ্গ করে চলেছে।
দুজনের একজনও কোন কথা না বলায় মনে হচ্ছিল যেন একটা সুকঠিন স্তব্ধতা ঘরের নিস্তরঙ্গ বায়ুস্তরে কুৎসিত একটা জিজ্ঞাসার চিহ্নের মত পাক খেয়ে খেয়ে চলেছে।
পরস্পর যেন পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে, কে কাকে এবং কে আগে প্রশ্ন করবে।
কিছুক্ষণ পরে কিরীটীই সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক সময় দগ্ধ চুরুটের অগ্রভাগের ছাইটা সম্মুখের ত্রিপয়ের ওপরে রক্ষিত অ্যাসট্রেটার ওপরে ঠুকে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, সুলতা দেবী, কয়েকটা কথা আপনার কাছ থেকে জানবার জন্য কষ্ট দিলাম আপনাকে।
সুলতা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিরীটীর কথার কোন প্রত্যুত্তর দিল না।
দুভাগ্যবশতঃ গতরাত্রে ঘটনা-বিপর্যয়ে ঠিক দুর্ঘটনাটার সময়ই মিঃ চৌধুরীর শিয়রের সামনে আপনার উপস্থিতিটা বলতে বলতে কথার মধ্যে একটুখানি ইতস্ততঃ করেই যেন কিরীটী আবার তার অর্ধসমাপ্ত বক্তব্যের জের টেনে বলে, বুঝতেই পারছেন মিস কর, পুলিসের কাছে আপনার জবানবন্দিরই সব চাইতে বেশী মূল্য এখন।
কিন্তু–সুলতা কিরীটীর দিকে মুখ তুলে কি যেন বলতে চেষ্টা করতেই, কিরীটী মৃদু স্মিতকণ্ঠে। বলে, অবশ্য ঠিক দুর্ঘটনাটা যে সময় ঘটে আপনিই অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি ছিলেন এবং এ-কথাও মিথ্যে নয় যে আপনার এ হত্যার ব্যাপারে কোনপ্রকার স্বার্থেরই যোগাযোগ থাকতে পারে না, তাহলেও বুঝতেই পারছেন এক্ষেত্রে আপনি যে একেবারে খুব সহজেই সমস্ত প্রকার সন্দেহ থেকে রেহাই পাবেন তাও নয়।
কিরীটীর কথায় সুলতার চোখেমুখে যেন একটা চাপা আতঙ্কের অস্পষ্ট আভাস জেগে ওঠে সহসা।
আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন মিঃ রায়?
অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে ঢোঁক গিলে সুলতা প্রশ্ন করে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, আপনি বোধ হয় জানেন না সুলতা দেবী, অনুসন্ধানের ব্যাপারে আমরা গোড়াতেই ঐ সন্দেহ নিয়েই কাজ শুরু করি, কিন্তু সে কথা যাক, ভয় পাবেন না যেন তাই বলে। বলছিলাম সমস্ত কিছুকেই একটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে ক্রমে ক্রমে আমরা নিঃসন্দেহে গিয়ে পৌঁছই। সন্দেহই আমাদের নিঃসন্দেহের সত্যে পৌঁছে দেয়।