কেন? এ-কথা বলছেন কেন? বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! ডিউটি দিতে এসে নাহলে কেউ অমন করে অঘোরে ঘুমোতে পারে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়ে!
ডাঃ সানিয়াল নির্বাক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
নিঃশেষিত চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট হতে পাইপটা বের করল কিরীটী এবং অন্য হাতে কিমনোর পকেট হতে টোবাকো পাউচটা বের করে খানিকটা টোবাকো পাউচ থেকে দুই আঙুলের সাহায্যে তুলে পাইপের গহুরে ঠাসতে থাকে ধীরে ধীরে। এবং পাইপটা ঠিক করতে করতে কতকটা যেন অন্যমনস্ক ভাবেই বলে, আমার কি মনে হয় জানেন ডাক্তার?
কি?
নার্স সুলতা কর শুধু যে তার ডিউটিতে গত রাত্রে মারাত্মক গাফিলতি করেছে তাই নয়, সে আমাদের সব কথা খুলে বলেনি।
সত্যি আপনার তাই মনে হয় নাকি মিঃ রায়?
হ্যাঁ। আরও অনেক কিছু সে জানে, যা ঘুমের দোহাই দিয়ে আমাদের কাছ থেকে চেপে গিয়েছে।
তাহলে আর একবার না হয় সুলতাকে ডাকি!
না। এখন তাকে আবার ডেকে এনে কোন ফল হবে না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, এ ব্যাপারে ইচ্ছে করে কোন কথা তার পক্ষে গোপন রাখবার কি কারণই বা থাকতে পারে?
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে রহস্যময় হাসি দেখা যায়। মৃদু হেসে সে বলে, কোথায় কার স্বার্থ—এত সহজেই ঠিক ধরা যায় না। অত সহজে যাচাই করতে গেলে কিন্তু আপনি ঠকবেন ডাক্তার। স্বার্থ ব্যাপারটা এমন সূক্ষ্ম ও ঘোরালো যে, অনেক সময় তার হদিস পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপর যেন কতকটা বেখাপ্পা ভাবেই কিরীটী ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বলতে পারেন ডাক্তার, আপনার ঐ নার্স সুলতা কর ও শকুনি ঘোষের মধ্যে পরস্পরের আলাপ-পরিচয়টা ঠিক কি ধরণের এবং কত দিনের?
প্রশ্নোত্তরে এবারে একটুখানি মৃদু হেসে ডাঃ সানিয়াল বলেন, কেন বলুন তো?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
সুলতা কর এখানেই থাকে এবং শুনেছি শকুনিবাবুর সঙ্গে সুলতার এ বাড়িতে ডিউটি দিতে আসবার আগে থেকেই নাকি আলাপ-পরিচয় কিছুটা ছিল।
কথাটা শুনে কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কিন্তু হঠাৎ এ-কথা আপনার মনে হল কেন মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
কারণ অবশ্য একটা আছে, কিন্তু তারও আগে আমাদের জানতে হবে কাল রাতে সুলতা কর তার জবানবন্দিতে কতকটা ইচ্ছে করেই বিশেষ একটা মিথ্যে কথা কেন বলেছিল?
বিশেষ মিথ্যে কথা! ডাঃ সানিয়াল বিস্মিত ও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, বিশেষ একটা মিথ্যে কথা। সে তার জবানবন্দিতে বলেছে, আপনার ঘরের তৈরি কফি খেয়েই নাকি সে ঘুমিয়ে পড়েছিল—কিন্তু কেন ঐ মিথ্যে কথাটা বললে!
কিরীটীর কথায় ডাঃ সানিয়াল চমকে উঠে বললেন, সে কি? কাল আমার তাকে আমি কখন কফি দিলাম?
জানি আপনি দেননি।
কিন্তু অমন একটা মিথ্যে কথা বলবার কি এমন কারণ?
এটা আর বুঝলেন না ডাক্তার! অর্থাৎ সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, হয়ত আপনার দেওয়া কফির মধ্যেই কোন তীব্র ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত ছিল। যার ফলে সে ঠিক হত্যার সময়টিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, কিন্তু আমি ভাবছি কি জানেন ডাঃ সানিয়াল, সে তাহলে কার দেওয়া কফি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল? কে দিল ঘুমের ওষুধ-মিশ্রিত কফি তাকে কাল রাত্রে?
আপনার তাহলে ধারণা, কাল রাত্রে কেউ-না-কেউ তাকে কফি দিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ রায়, এমনও তো হতে পারে কাল রাত্রে মিস কর আদপেই কফি পান করেনি! স্রেফ মিথ্যে কথা বলেছে।
না। মিস কর কাল রাত্রে কফি পান করেছিল এবং কফির সঙ্গে কোন তীব্র ঘুমের ওষুধও যে মিশ্রিত ছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।
কে তাহলে দিল তাকে কফি! ডাঃ সানিয়াল আপন মনেই যেন কথাটা উচ্চারণ করেন।
তাই তো আমিও ভাবছি। কিরীটী চিন্তান্বিত ভাবেই পুনরায় বলে, কে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি, মানে কে সুলতা করকে কাল রাত্রে ঘুম পাড়াবার জন্য ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কফি তৈরী করে দিয়েছিল এবং কে গিয়ে তাকে আপনার নাম করে কফিটা দিয়ে এসেছিল, সেটাই সর্বাগ্রে আমাদের এখন জানা দরকার।
কিন্তু আপনি যা ভাবছেন তাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমার মনে হয় মিঃ রায়, ডাঃ বলেন, মিস করকে এ ঘরে আর একবার ডেকে এনে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেই তো লেটা চুকে যায়। কে তাকে কফি করে গত রাত্রে দিয়ে এসেছিল!
ডাঃ সানিয়ালের কথায় কিরীটী হেসে ওঠে এবং হাসতে হাসতে বলে, কেন, আপনি দিয়ে এসেছিলেন সে তাই বলবে!
আমি যে তাকে কফি দিইনি আপনি তো তা জানেন, তাছাড়া আপনি তো আমার ঘরেই ছিলেন সে সময়। আমরা তো সব এক জায়গাতেই ছিলাম।
ডাক্তার, এসব ব্যাপারে আপনি দেখছি একেবারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আপনি এটা বুঝছেন না কেন, আপনি একজন মধ্যবয়সী পুরুষ—যে বয়সটা পুরুষের পক্ষে এবং বিপত্নীক পুরুষের পক্ষে বিশেষ করে একটু আশঙ্কাজনকই। তাই ঐ চাতুরীর সাহায্য সে নিয়েছে। চালাক মেয়ে!
কিন্তু এ কথাটা কি তার বোঝবার বয়স হয়নি যে জেরার মুখে সত্যটা প্রকাশ হবেই?
এখন সে ভুল শোনবার দোহাই দিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে হয়ত বাঁচবার চেষ্টা করবে।
কিন্তু তাতেই বা লাভটা কি?