রুচিরা আবার মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সাবিত্রী!
সাবিত্রী রুচিরার ডাকে যেন হঠাৎ চমকে ওঠে।
এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলে এবারে, সাবিত্রীকে হঠাৎ আজ এই বেশে সামান্য এক বাঈজীর পরিচয়ে এতদিন পরে দেখে খুব চমকে গিয়েছিস, না? আয়, বোস। রুচিরার দিকে তাকিয়ে সাবিত্রী রুচিরাকে আহ্বান জানায়।
না। কিন্তু—
ও, তুই তো শুনেছিলি যে স্বামীর ঘরে যাবার পর সাবিত্রী আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল—
না।
শুনিসনি? আশ্চর্য!
না, শুনিনি। আবার কিছুক্ষণ কতকটা যেন আত্মচিন্তায় বিভোর হয়েই সাবিত্রী নিঃশব্দে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকে।
হঠাৎ আবার সাবিত্রী কথা বলে, সত্যি ভাই, আমার নিজেরই কি এক এক সময় কম আশ্চর্য লাগে! বাপ মা নাম রেখেছিল সাবিত্রী। দিদিমার মুখে খুব ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম,যমের গ্রাস থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সাবিত্রী হয়েছিল সতী-সীমন্তিনী, নারীকুলে ধন্যা গরবিনী। আর আমিও সাবিত্রী—স্বামীকে নিজ হাতে হত্যা করে হয়েছি মুন্না বাঈজী! আমিও নারীকুলে অনন্যা, কি বলিস!
একটানা কথাগুলো বলে হাসতে লাগল সাবিত্রী। চোখেমুখে একটা নারকীয় জঘন্য উল্লাস যেন উপচে পড়তে থাকে।
সাবিত্রীর কথায় রুচিরা যেন সত্যিই একেবারে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
কি বলছিস তুই সাবিত্রী! স্বামীকে হত্যা করেছিস?
হ্যাঁ। কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই হাত, এখনও এতে—ভাল করে চেয়ে দেখ, হয়তো হত্যার রক্ত লেগে আছে।
কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে যেন সাবিত্রী তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে।
ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ সব কিছুই যেন সাবিত্রীর দুই চোখের দৃষ্টির মধ্যে ঐ মুহূর্তে একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।
দাঁড়া, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে আসিবলতে বলতে হঠাৎই যেন সাবিত্রী উঠে গিয়ে ঘরের দরজার কপাট দুটো বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল। এবং যেখানে বসেছিল সেইখানেই এসে বসল।
সাবিত্রী আবার বলে, ভাগ্যি সাবিত্রীর রূপ ছিল— বোকা পুরুষগুলোর চোখ-ঝলসানো রূপ ছিল, নচেৎ এত বড় কোনদিন কি হতে পারতাম! গরীবের ঘরে জন্মেছিলাম, কিন্তু সেই রূপের দৌলতেই তো ধনীর ঘরে বিকিয়ে গেলাম, সে-সব কথা তো তুই জানিসই।
হ্যাঁ, কিন্তু মৃদুকণ্ঠে কি বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল রুচিরা।
রূপের দৌলতে ধনীর ঘরের বধূ হবার সৌভাগ্যটুকুই কেবল সেদিন আমি তোকে বলেছিলাম রুচি, কিন্তু সে ধনীর ঘরের বধূর দৈনন্দিনের পরবর্তী যে দুঃখ ও লাঞ্ছনার কাহিনী সেটা সেদিন তোকে আমি শোনাইনি।
সাবিত্রী!
তাই। ধনীর পুত্রবধূ সাবিত্রীর কাহিনীই সেদিন তুই শুনেছিলি ভাই কিন্তু শোনানো হয়নি তোকে কেমন করে সেই বধূকে একদিন অনন্যোপায় হয়ে আজকের এই বাঈজীতে রূপান্তরিত হতে হল।
রুচিরা চেয়ে থাকে সাবিত্রীর মুখের দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সাবিত্রী আবার বলতে শুরু করে :
উঃ! যখন ভাবি না সেদিনকার কথাগুলো, ঘৃণায় লজ্জায় আর ধিক্কারে যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। তখন কি জানি কেন কলেজে পাঠিয়েছিল আমায়! খেয়াল—লম্পট, ধনী স্বামীর খেয়াল! আমায় কলকাতায় পড়তে পাঠালে। ছোট শহরের এক স্কুলে পড়ছিলাম, সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে কলকাতায় ভর্তি করে দিল বেথুনে। ধনীর খেয়াল কিনা তাই হঠাৎ একদিন ডাক এল আবার স্বামীর ঘরে ফিরে যাবার, পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে মধ্যপথেই।
হ্যাঁ, মনে আছে পরীক্ষার মাত্র দিনকয়েক আগে তুই পরীক্ষা না দিয়েই স্বামীর ঘর করতে চলে গেলি।
স্বামীর ঘরই বটে। তবে ভেতরের ঘর নয়, বাইরের ঘর। স্বামীর বিলাসভবন বাগানবাড়িতে, নাচঘরে।
বলিস কি!
এক বর্ণও মিথ্যে নয়। এবং সেই বাগানবাড়িতে গিয়েই শুনলাম বিবাহিতা হলেও স্বামীর গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশের নাকি আমার কোন অধিকার নেই—আমি সেখানে অহেতুক অনাবশ্যক বোঝা মাত্র।
কেন? প্রশ্নটা না করে চুপ করে থাকতে পারে না রুচিরা, তোকেও তো তিনি বিয়েই করেছিলেন।
তা করেছিলেন বটে, তবে ঘরে তাঁর প্রথম বিবাহিতা গৃহলক্ষ্মী ছিলেন। আমার স্বামীর প্রথমা পত্নী। তাঁর সন্তানের জননী। তাঁর ছাড়পত্রে আগেই শীলমোহর পড়ে গিয়েছিল কিনা।
সে কি! তুই শুনিসনি কিছু বিয়ের সময় যে তাঁর আগের স্ত্রী বর্তমান ছিল!
গরীব কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাপ আমার, তার ওপরে বিনা পণে এত বড় ঘরে এমন পাত্রে বিয়ে, তাঁরা হয়ত তাই আর কিছু শোনাটা প্রয়োজন মনে করেননি, কারণ জানবার কথা তো তাঁদেরই, আমার তো নয়। আমি তো তখন বাংলা দেশের বিয়ের কনে মাত্র। দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষমতাটা তো ছিল তাঁদেরই হাতে। আইনগত জন্মস্বত্ব সেদিন তো তাঁদের হাতেই ছিল।
হুঁ, তারপর?
তারপর আর কি! ঘর যেখানে জলসাঘর, সেখানে গৃহস্থ বধূর পরিণতি কি হতে পারে এ তত সহজেই বুঝতে পারিস।
স্বামী হয়ে তোকে—
মুহূর্তে যেন সাবিত্রীর দুই চক্ষুর তারা রুদ্র তেজে জ্বলে ওঠে।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, স্বামী! কাকে তুই স্বামী বলিস! যে তার নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে অনায়াসে লম্পটের ক্ষুদার অনলে সমর্পণ করতে পারে সে কি স্বামী? নাই বা হল এটা আইনগত সিদ্ধ বিয়ে, তবু তো অগ্নি-নারায়ণশিলা সাক্ষী রেখেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। মন্ত্র ও সেই অনুষ্ঠানকে না হয় সে অস্বীকার করলে, কিন্তু দায়িত্ব নীতি বা রুচি বলে কি কিছুই নেই? ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই যেন একটা চাপা আক্রোশে ফুলতে থাকে সাবিত্রী।