জংলী কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিরীটী বলে, হ্যাঁ রে, কিছু বলবি?
জংলীর মনে এবার বুঝি আশা জাগে, তাই ধীরে ধীরে মুখটা তোলে। তার চোখের কোন দুটি তখন জলে উবুচুবু।
কি হয়েছে রে জংলী?
বাবুজী! আর কি আপনার চাকরের দরকার হবে না?
ও এই কথা!
এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা যেন কিরীটীর কাছে জলের মতই পরিষ্কার হয়ে যায়। হাসতে হাসতে বলে, তোর দেশ, তোর আত্মীয়স্বজন—এদের সবাইকে ছেড়ে তুই আমার কাছে কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবি?
চোখের কোলে অশ্রুমাখা হাসি নিয়ে খুশীর উচ্ছলতায় গদগদ হয়ে জংলী জবাব দেয়, কেন পারব না বাবু, খুব পারব। আর এখানে থেকে আমি কি করব। এখানে আমার কেই বা আছে। মা বাপ তো আমার কতদিন হল মারা গেছে। আমার তো কেউ নেই।…শেষের দিকটা বালকের কণ্ঠস্বর কেমন যেন জড়িয়ে যায়।
তাই কার্শিয়াং ছেড়ে আসবার সময় কিরীটী জংলীকে তার আত্মীয়দের কাছ হতে চেয়ে নিয়ে আসে। তারাও ঘাড়ের বোঝা নামল ভেবে বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সে আজ দীর্ঘ সাত বছর আগের কথা। এখন জংলীর বয়স ষোল বৎসর। সে এখন বলিষ্ঠ যুবা; কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে সর্বদাই ছায়ার মত ঘোরে সে। অনেক সময় কিরীটীর সহকারী পর্যন্ত হয়। যেমনি বিশ্বাসী তেমনি প্রভুভক্ত।
পাহাড়ের দেশ থেকে কুড়িয়ে আনা অনাথ বালক, শ্নেহের মধুস্পর্শ পেয়ে আপনাকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দিয়েছে। মানুষ বুঝি অমনিই স্নেহের কাঙাল!
***
সেদিন সকালবেলায় একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটী সেদিনকার দৈনিকটার ওপর চোখ বুলোচ্ছিল। এমন সময় পত্রিকার দ্বিতীয় পাতায় বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা সনৎ-এর উধাও হওয়ার সংবাদটা তার চোখে পড়ল।
কিরীটী কাগজের লেখাগুলোর উপর সাগ্রহে ঝুকে পড়েছে, ঠিক এমনি সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ তার কানে এসে বাজল। জুতোর শব্দ আরোও এগিয়ে একেবারে দরজার গোড়ায় এলে কাগজ হতে মুখ না তুলেই হাসিমুখে সংবর্ধনার সুরে বললে, আসুন সুব্রতবাবু! আমি জানতাম আপনি আসবেন, তবে এত শীঘ্র বলতে বলতে কিরীটী হাঁক দিলে, জংলী, বাবুদের চা দিয়ে যা।
কিরীটী রায়ের কথা শুনে, সব্রত ও রাজু যেন হতবাক হয়ে গেছে। লোকটা কি সবজান্তা, তা না হলে না দেখেই জানতে পারে কি করে কে এল।
প্রথমটায় যে কি বলবে তা ওরা যেন ভেবেই পেলে না! বিস্ময়ের ভাবটা কাটবার আগেই কিরীটী কাগজের ওপর হতে চোখ সরিয়ে নিয়ে ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, নমস্কার সুব্রতবাবু, রাজেনবাবু, আরে দাঁড়িয়েই রইলেন যে! বসুন বসুন।
দুজনে এগিয়ে এসে দুখানা সোফা অধিকার করে বসল।
তারপর হঠাৎ এই সকালেই কি খবর বলুন শুনি? কিরীটী রায় সাগ্রহে শুধায়। সোফার ওপর বসতে বসতে সুব্রতই বলে, বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন তো, কেমন করে আমাদের না দেখেই বুঝলেন যে আমরাই এসেছি। আপনি কি পায়ের শব্দেই লোক চিনতে পারেন নাকি?
কিরীটী মৃদু হেসে বললো, কতকটা হ্যাঁও বটে, আবার নাও বটে। এইমাত্র খবরের কাগজ খুলতেই চোখে পড়ল সনৎবাবুর গায়েব হওয়ার চাঞ্চল্যকর সংবাদ। আর আপনাদের সঙ্গে তো আমার কথাই ছিল, আবার কোন রকম গোলমাল হলে আপনারা দয়া করে আমাকে একটা খবর দেবেন। সহজ নিয়মে দুয়ে দুয়ে চার কষে ফেলতে দেরী হয়নি। এত সকালে জুতোর শব্দ পেয়ে প্রথমেই তাই আমার আপনাদের কথাই মনে পড়ল, আর সেই আন্দাজের ওপরে নির্ভর করে আপনাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছি এবং আপনারাও যখন আমার অভ্যর্থনা শুনে চুপ করে রইলেন, তখন আমি স্থিরনিশ্চিত হলাম, আমার অনুমান মিথ্যা হয়নি।
চমৎকার তো।-রাজু বললে।
না, এর মধ্যে চমৎকারের বা আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কতকটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যে আর বাকিটা অনুমান—এই রীতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কার্যপদ্ধতি। বলতে পারেন কমনসেন্স-এর মারপ্যাঁচ মাত্র। একজন শয়তানকে তার দুষ্কর্মের সুত্র ধরে খুঁজে বের করা এমন বিশেষ কিছু একটা কঠিন বা আজব ব্যাপার নয়। দুষ্কর্মের এমন একটি নিখুত সূত্র সর্বদাই সে রেখে যায় যে, সে নিজেই আমাদের তার কাছে টেনে নিয়ে যায় সেই সূত্ৰপথে। এ সংসারে পাপ-পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পরিষ্কার ও পাপের তিরস্কার—এইটাই নিয়ম। আজ পর্যন্ত পাপ করে কেউই রেহাই পায়নি। দৈহিক শান্তি বা দশ বছর জেল হওয়া অথবা দ্বীপান্তর যাওয়াটাই একজন পাপীর শাস্তিভোগের একমাত্র নিদর্শন নয়; ভগবানের মার এমন ভীষণ যে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরও তার কাছে একান্তই তুচ্ছ। বিবেকের তাড়নায় মানসিক যন্ত্রণায় চোখের জলের ভিতর দিয়ে তিল তিল করে যে পরিতাপের আত্মগ্লানি ঝরে পড়ে, তার দুঃসহ জালায় সমস্ত বুকখানাই যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। স্থূল চোখে আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তাই বলে তার অস্তিত্বটাই একেবারে অস্বীকার করে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতাই বা আমাদের কোথায় বলুন? গায়ের জোরে সব কিছুকে অস্বীকার করতে চাইলেই কি মন আমাদের সব সময় প্রবোধ মানে সুব্রতবাবু?
হয়তো সব সময় মানে না।
হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। আচ্ছা যাক সে-কথা; তারপর আগে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো, শোনা যাক।
সুব্রত তখন ধীরে ধীরে এক এক করে সমস্ত ব্যাপারটাই খুলে বলল।
সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে কিরীটী কিছুক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে বসে রইল, তারপর সোফা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে করতে বললে, হ্যাঁ, জাহাজে দুটো সীট তো রিজার্ভ করেছেন। আরও দুটো সীট রিজার্ভ করুন সুব্রতবাব। পরশু সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়ছে তা হলে, কি বলেন? কিন্তু আমি ভাবছি, লোকটা আপনাদের চোখে বেশ স্বচ্ছন্দেই ধুলো দিয়ে গেল; আপনারা টেরও পেলেন না?