লোকটা অতর্কিত ঐ প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে প্রথমটা বেশ হকচকিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে রাজকে আক্রমণ করল।
কেউ শক্তিতে কম যায় না।
দুজনে জড়াজড়ি করে ঐ সরু গলির মধ্যেই লুটিয়ে পড়ে। সুব্রত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।
হঠাৎ এমন সময় তীব্র একটা অস্ফুট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে রাজু একপাশে ছিটকে পড়ল।
সুব্রতও কম বিস্মিত হয়নি। এক কথায় সে সত্যই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে আক্রমণকারী তড়িৎ বেগে উঠে পড়ে, সাইকেলে আরোহণ করে চালাতে শুরু করেছে।
রাজু যখন উঠে দাঁড়াল, সাইকেল-আরোহী তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুব্রত এগিয়ে এসে বলে, কি হল রাজু?–
০৪. কিরীটী রায়
রাজু যন্ত্রণায় কাতর ক্লিষ্ট স্বরে জবাব দিল, হাতের পাতায় কি যেন ফুটল সুব্রত।
সুব্রত পকেট থেকে টর্চটা বের করে বোতাম টিপল। কিন্তু আশ্চর্য, হাতের পাতায় কিছুই তো ফোটেনি। কিছু বিধেও নেই, এমন কি এক ফোঁটা রক্ত পর্যন্ত পড়েনি। হাতটা ভালো করে টর্চের আলোয় ঘুরিয়ে দেখা হল কোন চিহ্নই নেই। অথচ রাজার হাতের পাতা থেকে কনুই পর্যন্ত ঝিম ঝিম করছে অসহ্য যন্ত্রণায়। যেন অবশ হয়ে আসছে হাতটা।
কই, কিছু তো তোমার হাতে ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে না! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। সুব্রত বলে।
কিন্তু মনে হল হাতে যেন কি একটা ফুটল, ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাথা পর্যন্ত ঝিম ঝিম করে উঠেছে, এখনও হাতটায় যেন কোন জোর পাচ্ছি না। বললে রাজু।
চল ফেরা যাক। সুব্রত আবার বলে।
কিন্তু ঐ বাড়িটা দেখবি না? যে জন্য এলাম!
না, কাল সকালের আলোয় ভাল করে একসময় এসে বাড়িটা না হয় খোঁজ করে দেখা যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি ঐ সাইকেল-আরোহী লোকটা কে? কেনই বা এ পথে এসেছিল? লোকটা আচমকা এ পথে এসেছে বলে তো মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমাদের ফলো করেই এসেছিল।
যা হোক দুজনে আপাতত বাড়ির দিকে অগ্রসর হল।
রাতের আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। শেষ রাতের আঁধার তরল ও ম্লান হয়ে এসেছে। নিশিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে বয়ে যায়। রাজু আর সুব্রত বাড়ি ফিরে এসে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করে শয্যায় আশ্রয় নিল এবং শীঘ্রই দুজনের চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে।
সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙল, রাজু তখনও ঘুমিয়ে।
পূর্ব রাত্রের ব্যাপারটা সুব্রতর একে একে নতুন করে আবার মনে পড়ে। আজই একবার কিরীটীবাবুর ওখানে যেতে হবে। চাকরকে ডেকে চা আনতে বলে সুব্রত বাথরুমের দিকে পা বাড়াল।
বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা নলটা খুলে দিয়ে সুব্রত তার নীচে মাথা পেতে দাঁড়াল। ঝাঁঝরির অজস্র ছিদ্রপথে জলকণাগুলো ঝিরঝির করে সারা গায়ে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সুব্ৰত সমস্ত শরীর দিয়ে স্নানটা উপভোগ করল। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করার পর শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা হল। পূর্বরাত্রের জাগরণ-ক্লান্তি যেন অনেক পরিমাণে কমে গেছে।
ভিজে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে সোজা রাজুর কক্ষে এসে সুব্রত দেখে রাজু হাতের মুঠো মেলে কি যেন একটা একাগ্র দৃষ্টিতে দেখছে।
সুব্রত বললে, কি দেখছ অত মনোযোগ দিয়ে?
রাজু, সে কথার কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে একটা কার্ড সুব্রতর দিকে তুলে ধরে।
কার্ডটার গায়ে কালি দিয়ে ছোট ছোট করে লেখা—
কালো ভ্রমরের হুল, এমনি মিষ্টি-মধুর। কেমন লাগল বন্ধু!
কোথায় পেলে এটা? সুব্রত শুধাল!
রাজু বলল, জামার পকেটে ছিল এটা।
কার্ডটা রাজুর হাত থেকে টান মেরে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে দিতে সুব্রত তাচ্ছিল্যভরে বললে, বড় আর দেরি নেই, হুলের খোঁচা হজম করবার দিন এগিয়ে এল। চল চল, একবার টালিগঞ্জে কিরীটীবাবুর ওখানে যাওয়া যাক। এর পর গেলে হয়তো আবার তাঁকে বাড়িতে নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি, ওরা জানলে কি করে যে অত রাত্রে আমরা গলিপথে যাব?
চর আছে সর্বত্র, যারা হয়তো সর্বদা আমাদের ওপর নজর রেখেছে—এ কি, তুই যে স্নান পর্যন্ত সেরে ফেলেছিস। রাজু বলে।
হ্যাঁ, শরীরটা বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
তবে দাঁড়া, আমিও স্নানটা সেরে নিই চট করে।
***
টালিগঞ্জে সুন্দর একখানা দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িখানিই কিরীটী রায়ের।
কিরীটী রায়
রহস্যভেদী।
দ্বিতল বাড়িখানি বাইরে থেকে দেখতে সত্যই চমৎকার, আধুনিক প্যাটার্নের নয়, পুরাতন স্টাইলে সবুজ রংয়ের বাড়িখানি।
বাড়ির সামনে ছোট একটা ফুলফল তরিতরকারির বাগিচা। ওপরে ও নীচে সবসমেত বাড়িতে চারখানি মাত্র ঘর। ওপরের একখানিতে কিরীটী শয়ন করে, একটিতে তার রিসার্চ ল্যাবরেটারী। নীচে একটায় লাইব্রেরী ও আর একটায় বৈঠকখানা : তিনজন মাত্র লোক নিয়ে সংসার-কিরীটী নিজে, একটা আধবয়সী নেপালী চাকর নাম তার জংলী ও পাঞ্জাবী শিখ ড্রাইভার হীরা সিং।
ভৃত্য জংলীর যখন মাত্র ন বছর বয়স, তখন একবার কাশিয়াং বেড়াতে গিয়ে কিরীটী তাকে নিয়ে আসে।
মা-বাপ হারা জংলী এক দূর সম্পকীয় আত্মীয়ের কাছে থাকত। সেবারে কিরীটী যখন কাশিয়াং বেড়াতে গেল, তখন সব সময়ে তার ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটবার জন্য একটা অল্প বয়সের চাকরের খোঁজ করতেই তার এক বন্ধু জংলীকে এনে দেয়।
দীর্ঘ পাঁচ মাস কার্শিয়াং-এ কাটিয়ে কিরীটী যেদিন ফিরে আসবে, জংলীকে মাহিনা দিতে গেলে সে হাত গুটিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করলে। তাকে ঐ অবস্থায় দাঁড়াতে দেখে কিরীটী সস্নেহে শুধায়, কি রে? কিছু বলবি জংলী?