ক্ৰমে একদিন বাড়িটা জনহীন হয়ে ধীরে ধীরে শেষটায় পোড়ো বাড়ি বা ভূতের বাড়িতে পরিণত হল।
তারপর আজ প্রায় দশ বৎসর ধরে বাড়িটা পড়ে আছে। ভাড়াও কেউ নেয়নি, ক্ৰয় করতেও কেউ চায়নি।
সুব্রত গভীর রাত্রে ঘরে শুয়ে শুনত, রাতের বাতাসে নির্জন বাড়িটার খোলা আধভাঙা কপাটগলো বার বার শব্দ করে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। কখনও বা দেখত জ্যোৎস্নারাত্রে চাঁদের নির্মল আলো বাড়িটার সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে দঃস্বপ্নের মত করুণ বিষণ্ণে।
সেদিন গভীর রাত্ৰে ঘাম ভাঙতেই সুব্রত চমকে উঠল—সেই মাঠের ওপারে পোড়ো বাড়ির জানালার খোলা কপাটের ফাঁক দিয়ে যেন একটা আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে। পোড়ো বাড়িতে আলোর শিখা! আশ্চর্য কৌতূহলী চোখের পাতা দুটো রগড়ে নিল। তারপর আপন মনে বলল-না, ঐ তো মাঝে মাঝে হাওয়া পেয়ে আলোর শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে!
সুব্রত বিছানা থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। সহসা এমন নিশীথ রাত্রির জমাট স্তব্ধতা ভেদ করে জেগে উঠল একটা তীক্ষ্ণ বাঁশীর আওয়াজ। তারপর আর একটা, আরও একটা; পর পর তিনটে।
আকাশে মেটে-মেটে জ্যোৎস্না উঠেছে। স্বল্প আলো-আঁধারিতে পোড়ো বাড়িটা যেন একটা মাতৃ-বিভীষিকা জাগিয়ে তুলেছে! চারিদিক নিস্তব্ধ। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই। জীব-জগৎ সুপ্তির কোলে বিশ্রাম সুখ লাভ করছে। দিবাভাগের জনকোলাহল মুখরিত জগৎ যেন এখানকার এই স্তব্ধ ঘুমন্ত পৃথিবী থেকে দূরে—অনেক দূরে।
এমনি সময়ে হঠাৎ পোড়ো বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিককার একটা ঘরের একটা জানালার কপাট খালে গেল এবং সেই খোলা জানালার পথে একটা টর্চের সতীব্র আলোর রশ্মি মাঠের ওপর এসে পড়ল।
সুব্রতর দু চোখের দৃষ্টি এবারে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। রহস্যঘন পোড়ো বাড়ির মধ্যে যেন হঠাৎ প্রাণ-স্পন্দন!
ইতিমধ্যে কখন একসময়ে রাজু এসে ওর পাশেই দাঁড়িয়েছে সুব্রত তা টেরও পায় নি। হঠাৎ কাঁধের ওপর মদ, স্পর্শ পেয়ে সে চমকে ফিরে তাকাল, কে? ও রাজু!
হ্যাঁ, কিন্তু কি আমন করে দেখছিলি বলা তো?
চেয়ে দেখ না। মাঠের ওদিকে ঐ ভাঙা বাড়িটা!…
আলোটা ততক্ষণে নিভে গেছে—নির্জন মাঠের মাঝে অসপালট চন্দ্রালোকে সহসা যেন একটা বিভীষিকার আবছা ছায়া নেমে এসেছে।
তাই তো! নির্জন পোড়ো বাড়িতে হঠাৎ কারা আবার এসে হাজির হলেন?—এতক্ষণে বললে রাজ্য।
হ্যাঁ, তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক রাজু—
কি বলছিস?
শিকারী বিড়াল?
হ্যাঁ, তার গায়ের গন্ধ পেয়েছি। তারপর হঠাৎ চকিতে ঘরে দাঁড়িয়ে সুব্রত বললে, চল, একবার ওদিককার পথটা ঘরে দেখে আসা যাক।
এই রাত্রে?
ক্ষতি কি, চল না!
বেশ, চল। তাড়াতাড়ি গায়ে একটা শার্ট চাপিয়ে দেওয়াল-আলমারি থেকে সিলাককডোর মইটা ও একটা টিচ নিয়ে সৰ্ব্বত ও রাজ, রাস্তায় এসে নামল।
মাথার ওপর রাত্রির কালো আকাশ তারায় ভরা। অস্তমিত, চাঁদের আলো তখন আরো মালান হয়ে এসেছে। চারিদিকে থমথমে জমাট রাত্রি, যেন এক অতিকায় বাদাড়ের সবিশাল ডানার মত ছড়িয়ে রয়েছে। বড় রাস্তাটা অতিক্রম করে দুজনে এসে গলির মাথায় দাঁড়াল।
কিরীটী রায়কে মনে পড়ে? সুব্রত সহসা একসময় প্রশ্ন করে।
কোন কিরীটী রায়? ঐ সে আমাদের এখানে ফিরে আসার পর প্রীতিভোজের নিমন্ত্রণে যিনি এসেছিলেন? সাড়ে ছয় ফুট লম্বা গৌর বর্ণ, পাতলা চেহারা, মাথাভাতি কোঁকড়ানো চুল, চোখে পুর লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা!
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঐ যে শখের ডিটেকটিভ, গোয়েন্দাগিরি করেন, টালিগঞ্জে না কোথায় থাকেন? যিনি ড্রাগনটা তোর কাছ হতে চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নির্জলা শখেরই গোয়েন্দাগিরি! কাকার প্রকান্ড কেমিকেল ল্যাবোরেটারী আছে। আর সে তাঁর একমাত্র ভাইপো।
ওর নামও তো খুব শুনি।
আমাদের পাশের বাড়ির শান্তিবাবুর বিশেষ বন্ধু উনি। তিনিই আমাদের কিরীটীবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা শান্তিবাবুর সঙ্গে কিরীটীবাবুকেও নিমন্ত্রণ করেছিলাম। মনে নেই, কিরীটীবাবু আমাদের সব কাহিনী শুনে কি বলেছিলেন। আবার কোন আপদ-বিপদ ঘটলে তাঁকে যেন আগেই খবর দেওয়া হয়। ওঁর কথাটা আমার একেবারেই মনে ছিল না। কাল সকালে উঠেই একবার তাঁর ওখানে যেতে হবে, মনে করো।
ইতিমধ্যে ওরা চলতে চলতে দুজনে গলিটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে। আর অল্প একটু এগোলেই পোড়ো বাড়িটার পেছনের দরজার কাছে এসে পড়বে। এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের ঘন্টি শোনা যায়। পরক্ষণেই দুজনের দৃষ্টি পড়ল আবছা আলো-আঁধারে কে একজন তীব্র বেগে সাইকেল চালিয়ে গলির ভিতর দিয়ে ঐদিকেই এগিয়ে আসছে। সাইকেলের সামনের আলোটা টিম টিম করে জলছে।
রাজু বা সুব্রত সাবধান হয়ে সরে যাবার আগেই সাইকেল-আরোহী হড়মড় করে এসে একেবারে অতর্কিতে রাজুর গায়ের ওপরই সাইকেল সমেত পড়ল।
সরি, আপনার লেগে গেল নাকি? দুঃখিত–
রাজুর পায়ে বেশ লেগেছিল। সে উষ্ণস্বরে বললে, ঐ ভাঙ্গা আলো লাগিয়ে বাইক চালানো! চলুন আপনাকে hand over করে দেব।
আহা, আপনার কোথাও লেগেছে নাকি? কিন্তু আপনিই বা এত রাত্রে এই চোরাগলির মধ্যে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন কেন?
কেন হাওয়া খেতে বের হয়েছি শুনতে চান? বলেই ক্রুদ্ধ রাজু লোকটার দিকে লাফিয়ে এসে সজোরে লোকটার নাকের ওপরে একটা লৌহ-মুষ্ট্যাঘাত করে।