উঃ, এত বড় আপসোস সে রাখবে কোথায়?
দেওয়ালে টাঙানো ওয়াল-ক্লকটার দিকে তাকিয়ে সুব্রত দেখল বেলা তখন আটটা বেজে পনেরো মিনিট। সাতটা তিরিশে জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। বাইরের দিকে তাকায়। বৃষ্টি থেমেছে, মেঘ-ভাঙা আকাশে সূর্যের আত্মপ্রকাশ, স্নিগ্ধ-সুন্দর।
এখন তাহলে কি করা যায় বল তো সু?
আর দেরি করা নয়। চল, এখনই গিয়ে আগে তো থানায় একটা ডাইরি করিয়ে আসি!
তাতে কি সংবিধা হবে?
তাহলে অন্তত বেতারে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটা সংবাদ দেওয়া যেতে পারে, যদি আজকের জাহাজেই তারা গিয়ে থাকে!
তারপর?
তারপর সামনের শনিবারে জাহাজে সীট পাই ভাল, না হয়। পরের মঙ্গলবার আমাদের রেঙ্গুনের জাহাজ ধরতেই হবে, তা যে উপায়েই হোক। শুধু রেঙ্গুনে কেন, সনৎদার খোঁজে পৃথিবীর আর এক প্রান্তে যেতে হলেও যাব। আমি খাঁজে বের করবই, আর একবার সেই শয়তান-শিরোমণির সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়াব। সে আমার ধৈয্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে, স্কাউন্ড্রেল!
মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন, তোদের চা জুড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে?
সুব্রত মার হাতে চিঠিটা তুলে দেয়। চিঠিটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে এক অস্ফুট কাতরোক্তি মার কন্ঠ হতে নির্গত হয়ে আসে, সর্বনাশ! কালো ভ্ৰমর!
সুব্রত দাঁতে দাঁত চেপে কঠিনস্বরে বললে, হ্যাঁ মা, আবার সেই কালো ভ্ৰমর! কিন্তু এবার সত্যিসত্যিই তার পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে।
কথাবার্তায় আর সময় নষ্ট না করে, কিছু, জলখাবার ও চা খেয়ে, রাজ্য ও সুব্রত তাড়াতাড়ি লালবাজারের দিকে ছুটল।
লালবাজারে গিয়ে সোজা তারা একেবারে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সব বললে।
ওদের সমস্ত কথা মনোযোগ সহকারে শুনে সাহেব আবশ্যকীয় সব কথা নোট করে নিলেন এবং বললেন, বাব, তোমাদের কথা শুনে আমি আশ্চর্য! এ একেবারে miracle (অত্যাশ্চর্য)! যা হোক, আমি এখনই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বেতারে সংবাদ প্রেরণের সব বন্দোবস্ত করছি।
সুব্রত লালবাজার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পোস্ট-অফিসে গিয়ে রেঙ্গুনে সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর সলিল সেনকে একটা তারা করে দিল—সনৎ সম্পর্কিত সকল ব্যাপার জানিয়ে।–
তারপরই দুজনে গেল জাহাজের বুকিং অফিসের দিকে। জাহাজ ছাড়বে শনিবার-পরশুর পরের দিন, এবং সেই জাহাজে দুখানা সীট রিজার্ভের সব বন্দোবস্ত করে যখন ওরা বাড়ির দিকে পা বাড়াল, তখন প্রখর রৌদ্রে সারা পৃথিবী যেন ঝলসে যাচ্ছে। কমচঞ্চল শহরের বকে অগণিত নরনারী ও বাসট্রামের আনাগোনার শব্দ।
ফিরতি-পথে ওরা যে রাস্তাটা দিয়ে আসছিল, তার দু পাশে চীনা পট্টি। সেই চীনা পট্টি দিয়ে চলতে চলতে একসময় রাজু চাপা, গলায় সুব্রতকে বললে, একটা লোক অনেকক্ষণ থেকে আমাদের পিছ নিয়েছে সুব্রত!
সুব্রত পিছনপানে না তাকিয়েই বললে, তাই নাকি?
অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়।
লোকটা কি বাঙালী?
না, বর্মী বলে মনে হয়।
কি করে বুঝলে যে লোকটা আমাদের পিছ নিয়েছে?
রাজু প্রত্যুত্তরে একটু হাসলে মাত্র, তারপর বললে—তুই ভুলে যাচ্ছিস যে, একদিন এ দলে আমি বহু ঘোরাফেরা করেছি। শিকারী বিড়ালের গোঁফ দেখলেই আমাদের চিনতে কষ্ট হয় না।
আচ্ছা ওকে অনুসরণ করতে দে। দেখা যাক, লোকটার দৌড় কতদূর পর্যন্ত!
একটা কাজ করলে হয় না?
কি?
আয়, শ্যামবাজারের একটা ট্রামে এখন উঠি; খানিকটা ঘরে-ফিরে পরে বাড়ি যাওয়া যাবে।
মন্দ কি, বেশ তো!
চট করে তারা একটা শ্যামবাজার-গামী ট্রামে চেপে বসল।
***
আমহার্ট স্ট্রীটের যেখানটায় সুব্রতর বাড়ি, তার পিছনে একটা খালি মাঠ। তারই ওপাশে বহুদিনকার একটা চারতলা বাড়ি।
শোনা যায় এককালে নাকি বাড়িটা ছিল এক মস্ত ধনী ব্যবসায়ীর। ব্যবসায়ী মারা যাবার পর, তার ছেলে যখন সমস্ত অর্থের মালিক হয়ে বসল, তখন বিপুল অর্থ হাতে পেয়ে তার মনে হল (বেশীর ভাগ লোকের যা হয়), দুনিয়া তো তারই। এখনকার রাজাই তো সে। স্ফূর্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে সে চোখ বাজে আকাশকুসম স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে। আর হতভাগ্য পিতার বহু কষ্টার্জিত অৰ্থ রাশি দুদিনের জন্য তাকে নিয়ে পুতুল-খেলা খেললে, পরে তাকে হাত ধরে পথের ধুলোয় বসিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুখের দিনে একদিন যারা ছিল দিবারাত্র পাশাপাশি বন্ধুর মত, পরমাত্মীয়ের মত, সর্বনাশের নেশায় একদিন যারা ছিল তার মুখোশপরা একনিষ্ঠ বন্ধু, তারাই আজ অচেনার ভান করে অলক্ষ্যে বিদায় নিয়ে গেল। কেউ বা যাবার বেলায় দিয়ে গেল শুষ্ক সহানভূতির সোনালী হাসি।
যার মুখে একদিন সোনার বাটিতে জমাটবাঁধা দধি উঠিত, আজ তার মুখে ভাঙা কাঁসার বাটিতে জলটুকুও ওঠে না।
সৌভাগ্যের শৈলশৃঙ্গ হতে সে দুর্ভাগ্যের নরককুন্ডে নেমে এল। এতকাল সে শুধু হেসে-গেয়েই এসেছে, আজ তার দু চোখে জল উঠল ছলছলিয়ে।
তারপর অভাবের তাড়নায় অধীর হয়ে একদিন সে নিজের শয়নগৃহেরই কড়িকাঠের সঙ্গে পরনের কাপড় গলায় দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিল। অভিমানে না দুঃখে কে জানে!
এদিকে একজন ধনী মারোয়াড়ী লোকটার জীবিতকালেই বাড়িখানা ক্রয় করে নিয়েছিল দেনার দায়ে, কিন্তু ঐ কেনা পর্যন্তই। কারণ বাড়িখানা সে কোন কাজে লাগাতে পারলে না। সমস্ত রাত্রি ধরে নাকি বুভুক্ষিত অশরীরীর দল সারা বাড়িময় হাহাকার করে বেড়াত। লোক এসে একদিনের বেশী দীদিন ও বাড়িতে টিকতে পারে না। সারারাত্রি ধরে কারা নাকি সব সময়ে কেঁদে কেঁদে ফেরে। অসহ্য তাদের সেই বকভঙা বিলাপ।