বন্ধু, বন্ধু! চমৎকার! কিন্তু তোমার নামে যে একটা পরোয়ানা আছে।
পরোয়ানা? কিসের পরোয়ানা তা শুনতে পাই না?
নিশ্চয়ই। কালো ভ্রমরের মৃত্যু-গুহায় হাজিরা দেওয়ার।
তাহলে বলব তুমি বা তোমার দলপতি এখনও সনৎ রায়কে ঠিক চিনতে পারনি!
চিনিনি তোমাকে? কে বললে? পাশ হতে চাপা কণ্ঠে অপর কেউ যেন বলে উঠল অকস্মাৎ ৷
অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় বারান্দাটা যেন আশ এক ভৌতিক সম্ভাবনায় থম থম করে ওঠে সহসা।
আকাশ ভেঙে যেন আজ রাতে বৃষ্টি নেমেছে…ঝম…ঝম…ঝম…ঝম। সেই অবিশ্রাম একটানা শব্দেও পার্শ্ববর্তী আগন্তুকের কন্ঠস্বরটা শুনতে কষ্ট হয় না সনৎ-এর।
অতর্কিতে সেই কন্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে চমকে সনৎ ফিরে তাকায়। ইতিমধ্যে ঠিক তার পশ্চাতে কখন যে আরও চারজন এসে নিঃশব্দে উপস্থিত হয়েছে তা সে টেরও পায়নি। প্রথমটা সে অতকিতে এতগলো লোকের আবির্ভাবে বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিমেষে নিজেকে সামলে নেয়।
একটা বেচাল বা অসতর্ক হলেই লোকগুলো যে তার ওপরে চোখের নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সনৎ ভেবেই পায় না, কি উপায়ে সে নিজেকে এই মুহূর্তে রক্ষা করতে পারে!
তোমাদের কি উদ্দেশ্য তা জানতে পারি কি?
কেন বন্ধু? এখনও কি তোমার সে কথা বঝতে কষ্ট হচ্ছে? নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি যে, কালো ভ্রমরের প্রতিশ্রুতির টাকা বা কালো ভ্রমরের ন্যায্য পাওনা এখনও শোধ করনি তুমি?
কালো ভ্রমরের ন্যায্য পাওনা! হুঁ, তা পাওনাই বটে!
এত বড় বিপদের সম্পমখীন হয়েও সনৎ-এর কন্ঠস্বর অবিচলিত। বলে, বেশ, সে টাকা আমি কালই দিয়ে দেব।
অনেক দেরি করে ফেলেছ সনৎবাবু, সুদে-আসলে এখন সে টাকার অঙ্ক তোমার ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কি ভাবে যে এখন তোমাকে সেটা শোধ করতে হবে, সে কথা কালো ভ্ৰমরই তোমায় যথাসময়ে বাতলে দেবে—। রূঢ় বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে লোকটি বলে।
লোকটার শেষ কথাগলি যেন মুখেই আটকে গেল। বিদ্যুৎগতিতে সনৎএর বজ্রমুষ্টি ভীমবেগে এসে লোকটার চোয়ালে আঘাত করল।
সনৎ দ্বিতীয়বার মুষ্টি উত্তোলনের আগেই দুজন তাকে পশ্চাৎ দিক থেকে চকিতে জাপটে ধরল।
আক্রান্ত হয়ে সনৎ নিজেকে মুক্ত করবার জন্য প্রথমেই সামনে যে ছিল তাকে পা দিয়ে লাথি বসাল।
ধরা শয়তানটাকে। শক্ত করে চেপে ধরা। কে যেন বলে।
সনৎ ইতিমধ্যে নিজেকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্রগতিতে সিংহ বিক্রমে সম্মখের লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোক দুটিও সনৎকে দু পাশ হতে আক্রমণ করল।
অন্ধকার জলে-ভেজা বারান্দায় ওদের হুঁটোপুটি চলতে লাগল। এমন সময় কোথা থেকে ছায়ার মত আরও দুজন লোক এসে সেখানে হাজির হল। কাজেই সনৎকে শীঘ্রই বিপক্ষ দলের কাছে হার মানতে হল। এতগলো লোকের মিলিত আক্রমণে পরাজিত সনৎ-এর মুখটা ততক্ষণে আক্ৰমণকারীদের মধ্যে একজন ক্ষিপ্ৰহস্তে বেঁধে ফেলেছে, এবং দুজনে মিলে তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভিজতে ভিজতে সকলে সনৎকে বয়ে রাস্তায় এসে নামল।
ওদের বাড়ির অল্প দূরেই রাস্তার ওপর বৃষ্টির মধ্যে একখানা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। লোকগুলো তাড়াতাড়ি সনৎকে নিয়ে সেই গাড়ির মধ্যে তুলল।
পরমুহূর্তে গাড়িটা ছেড়ে দিল।
০৩. পরদিন সকালে
পরদিন সকালে যখন রাজুর ঘুম ভাঙল, সে দেখলে সুব্রত তখনও ঘুমোচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে সুব্রতকে ডেকে বললে, এই সুব্রত, ওঠ ওঠ, বেলা অনেক হয়েছে।
রাজার ডাকে সবে সুব্রত চোখের পাতা রাগড়াতে রাগড়াতে শয্যার ওপরে উঠে বসেছে, ভূত্য এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।—বড়দাদাবাব, উঠেছেন শিব? সুব্রতই প্রশ্ন করে।
তিনি তো তাঁর ঘরে নেই!
নেই? আর কালকের সেই বাবুটি?
না, তিনিও নেই।
সে আবার কি! এত সকালে গেল কোথায় তারা? বাইরে তখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, বর্ষাসিক্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রাজু বলে, এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় আবার গেল তারা?
মা এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন, হ্যাঁ রে, সনৎ কোথায় গেছে জানিস? তাকে দেখলাম না তার ঘরে?
না তো মা! রাজা জবাব দেয়।
চল তো রাজু, ওদের ঘর-ব্দটো একবার ঘরে দেখে আসি।
প্রথমেই রাজু ও সুব্রত এসে সনৎ-এর ঘরে প্রবেশ করল। নিভাঁজ শয্যা দেখে মনে হয় রাত্ৰে শয্যা স্পর্শ পর্যন্ত করা হয়নি।
হঠাৎ সামনের টী-পয়ের ওপর সুব্রতর নজর পড়ে, জলের গ্লাসটা চাপা দেওয়া একটা ভাঁজকরা হলুদবর্ণের তুলট কাগজ। সুব্রত এগিয়ে এসে কাজগটা তুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই বিস্ময়ে আতঙ্কে যেন স্তব্ধ হয়ে যায় ও।
সেই ভ্ৰমর-আঁকা চিঠি!
নমস্কার। চিহ্ন দেখেই চিনবো। সনৎকে নিয়ে চললাম। ভোরের জাহাজেই বর্মা যাব। ইচ্ছা হলে সেখানে সাক্ষাৎ করতে পার।
–কালো ভ্রমর
কিরে ওটা? রাজু এগিয়ে আসে।
সুব্রত চিঠিটা রাজুর হাতে তুলে দেয় নিঃশব্দে।
আবার সেই কালো ভ্ৰমর! মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী! উঃ, কি বোকাটাই সকলকে বানিয়ে গেল! শয়তান! ডিব্রুগড় থেকে আসছি, অমরবাবুর ভাইপো! ধাপ্পাবাজ! সনৎদা কি তবে শয়তানটাকে চিনতে পেরেছিল?
গতরাত্রের আগাগোড়া ব্যাপারটার মধ্যে তার এতটকু উৎসাহও ছিল না। সে যেন এড়াতেই চাইছিল। বলে রাজু।
রাগে দুঃখে অননুশোচনায় সুব্রতর নিজেরই চুল চলে যেন নিজেরই টানতে ইচ্ছে করে।