সাহায্য অবিশ্যি আপনারা আমাকে অনেক ভাবেই করতে পারেন, তবে যেজন্য আমি এতদূর আশায় ছুটে এসেছি, যদি আপনারা একটিবার দয়া করে আমার সঙ্গে রেঙ্গুনে যান, তা হলে আপনাদের সকলের সাহায্যে হয়তো ব্যাপারটার একটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখতে পারতাম। তাছাড়া আত্মীয় বলতে আমার ঐ কাকাই যা একজন বেঁচেছিলেন। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে যেন। একটা থেমে আবার বলতে শার করেন, অবিশ্যি বলাই বাহুল্য যে আপনাদের যাতায়াতের সর্ববিধ খরচ আনন্দের সঙ্গেই আমি বহন করব ৷
খরচের কথা বাদ দিন বনমালীবাবু। যেভাবে আমরা, বিশেষ করে আমি অমরবাবুর কাছে ঋণী, সামান্য অর্থের কথা সেখানে উঠতেই পারে না। কথাটা বলে সুব্রত।
তাছাড়া আমার কেন যেন মনে হচ্ছে মিঃ রায়, আমার খুড়ো মশাইয়ের এই নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপারে কোথাও যেন বেশ একটি গোলমাল আছে।
গোলমাল আছে মানে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, গোলমাল। ভেবে দেখান, হত্যাই যখন তাঁকে করা হল, তখন অমন করে হত্যাকারী অস্ত্রের সাহায্যে মত ব্যক্তির মুখ বিকৃত করে গেল কেন? কি তার উদ্দেশ্য ছিল? তারপর সংবাদপত্রে ঐ যে দস্যু কালো ভ্রমরের কথা ইঙ্গিত করেছে, কারণ ভেবে দেখুন, আপনাদের উইলের ব্যাপার। আমার কাকা আপনাদের সাহায্য করায় ঐ কালো ভ্ৰমরের বিপক্ষে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল, সে ব্যাপারে কালো ভ্ৰমরের একটা আক্রোশ কাকার ওপর থাকাটাও অসম্ভব নয়—তাতে করে ঐ দস্যুকেই আবার সন্দেহ হয়। তাছাড়া আপনাদের উইলের ব্যাপার নিয়ে কালো ভ্ৰমরের দলের সঙ্গে বহ সংঘর্ষ হয়েছে বলে ও বিষয়েও আপনাদের খানিকটা সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতাও তো আছে। এই সব কারণেই আমি আপনাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
সনৎ বললে, কিন্তু এ হত্যার ব্যাপারে আদপেই কালো ভ্ৰমরের কোন হাত নাও তো থাকতে পারে। কালো ভ্ৰমরের ঘাড়েই বা দোষটা চাপাচ্ছেন কেন? হত্যার ব্যাপারে কালো ভ্রমর যে জড়িত আছে, এমন কোন নিদশন। কি পাওয়া গেছে? কিংবা সে কি কিছু রেখে গেছে? সবটাই তো সংবাদপত্রের অভিমত— সনৎ-এর কথায় বাধা দিয়ে সুব্রত ও রাজু বলে উঠল, সে তুমি যাই বল সনৎদা, আমরা একেবারে হলফ করে বলতে পারি-কালো ভ্রমর ছাড়া এ ব্যাপারে অন্য কারও হাত নেই। মনে পড়ে তোমার, সেই রেঙ্গুনের বাড়িতে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাক্সে করে সেই চিঠি ও ড্রাগন পাঠাবার কথা? সে-সব কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি তুমি এত তাড়াতাড়ি?
না ভুলিনি এত তাড়াতাড়ি। কিন্তু সেই ব্যাপারের সঙ্গে এর এমন কি ঘনিষ্ঠ সম্প্ৰবন্ধ আছে সুব্রত, সেটাই ভাই যেন বঝে উঠতে পারছি নে!
কেন? সেই চিঠি ও ড্রাগন পাঠানোর পর অমরবাবুর এইরপ শোচনীয় মৃত্যু, এর পরও কি তোমার বোঝবার অসুবিধা হচ্ছে?
অসুবিধাটা ঠিক কালো ভ্ৰমরের এই ব্যাপারে জড়িত থাকার সম্ভাবনাটাই নয়, অন্য কিছু!
কি?
সময় হলে বলব, এখন না। সনৎ যেন ইচ্ছা করেই চাপ করে যায়।
আমি কিছু, বুঝতে পারছি না। সনৎদা, এই সোজা ব্যাপারটাকে তুমি ঘুরিয়েই বা দেখছ কেন?
আপনার বুঝি এ মৃত্যু-ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে সনৎবাবু? সহসা বনমালীবাবু প্রশ্ন করলেন।
ভৃত্য এসে ঘরের মধ্যে ঐ সময় প্রবেশ করল; বললে, মা বললেন, খিচুড়ি তৈরী হয়ে গেছে। দেরি করলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। আপনাদের কি খাওয়ার জায়গা করা হবে?
সনৎ জবাব দিল, হ্যাঁ, জায়গা করে দিতে বল গে…তা হলে বনমালীবাবু, আপনিও এই গরীবদের ঘরে দুটো খুদকুঁড়ো যা হয়— আশা করি আপত্তি নেই!…
বিলক্ষণ, একথা আবার জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন? আপনারা না বললেও আমি সেধে খেতাম। আমার আবার হোটেলের খাওয়াও তেমন সহ্য হয় না।
আহারের স্থান হলে সকলে গিয়ে একত্রে খেতে বসল। এবং বেশ তৃপ্তি সহকারেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হল।
বাইরে তখন মষিলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। প্ৰমত্ত বায়ুর হাহাকারে দিগন্ত ঝঙ্কৃত ও কম্পিত হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎঝলকে চোখ যেন ঝলসে যায়। সেই ঝড়বাদলের রাত্ৰে সুব্রতই যেচে বনমালীবাবুকে সেখানে থাকতে অনরোধ জানালে। তিনিও সম্মত হলেন। একতলার বৈঠকখানার পাশের ঘরে বনমালীবাবু্র শয়নের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হল।
রাত যত বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঝড় ও জলের প্রকোপও যেন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বনমালীবাবুকে এইভাবে যেচে বাড়িতে স্থান দেওয়াটা গোড়া হতেই যেন সনৎ-এর মনঃপুত হয়নি। তার পরামর্শ না নিয়েই কেন যে সুব্রত বনমালীবাবুকে গৃহে স্থান দিল! সনৎ-এর চোখে ঘুম আসছিল না। তাই সে এক সময় ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের টানা বারান্দায় রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিশীথ রাতের তাণ্ডব-লীলা দেখছিল। বাইরের রুদ্র তাণ্ডব কি তার মনের মধ্যেও তাণ্ডব শুরু করেছে? পাশের ঘরেই সুব্রত ও রাজা অঘোরে নিদ্রা দিচ্ছে। আর তার পাশের ঘরে শুয়ে বনমালীবাবু।
এলোমেলো চিন্তা করতে করতে একসময় বুঝি সনৎ কেমন একটি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, সহসা কে যেন নিঃশব্দে সনৎ-এর কাঁধের উপর হাত রাখলে!
কে? চমকে উঠে সনৎ ফিরে তাকায়।
বারান্দায় সিলিংয়ে ঝোলানো ম্রিয়মাণ বৈদ্যুতিক আলোর খানিকটা তীর্যগতিতে এসে এদিকে পড়েছে।
আগন্তুক বললে, আমায় চিনতে পেরেছ, সনৎবাবু?
সনৎ যেন আগন্তুকের কথায় এতটকু ভয়ও পায়নি এমনি ভাবে ঠোঁটের কোণে মৃদু একটুকরো হাসি টেনে এনে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললে, তোমার কি মনে হয় বন্ধু?