ইরাবতীর উচ্ছসিত জলধারা অক্লান্ত কল্লোলে বয়ে যাচ্ছে।
স্বল্প চন্দ্রালোক নদীর বুকে ঢেউয়ের চড়ায় চড়ায় যেন কি এক মায়াস্বপ্নের সৃষ্টি করেছে। অদূরে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ইরাবতীর স্রোত-বিধৌত বিশাল গৌতম পর্বত প্যাগোডা মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রকিরণ-স্নাত হয়ে।
সকলে লঞ্চ হতে নামল একে একে তীরে।
কিরীটী পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করল। তাতে আলো ফেলতে দেখা গেল তার ওপর সাঙ্কেতিক ভাবে কি কতকগুলো লেখা আছে।
কিরীটী সেই কাগজ দেখতে দেখতে বললে, ঐ দেখা যাচ্ছে গৌতম পর্বত। বোধ হয় প্যাগোডার দক্ষিণ কোণ দিয়ে এগিয়ে যেতে একটা চন্দনগাছ পাওয়া যাবে। চলুন, আর দেরি নয়, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলুন।
সকলে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল।
কারও মুখে একটি কথা নেই; উৎকণ্ঠিত আগ্রহে রুদ্ধনিঃশ্বাসে এক রহস্যময় বিভীষিকার দ্বারোদঘাটন করতে সব এগিয়ে চলেছে যেন নিঃশব্দে।
এই সেই প্যাগোডা…চল দক্ষিণ কোণ ধরে। চলতে চলতে একসময় থেমে কিরীটী বললে।
সকলে আবার কিছুদূর এগিয়ে চলল। কিন্তু কোথায় ভাঙা বুদ্ধদেবের মতি!
সুব্রত ও রাজু বললে, মিঃ রায়, আমরা বোধ হয় ভুলপথে এসেছি।
কিরীটী জোরগলায় বললে, না, ঠিকই চলেছি। ঐ দেখন ভাঙা বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখা যাচ্ছে সামনেই আমাদের।
সত্যই অদূরে ভাঙা একটা বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখা গেল, একখণ্ড বড় পাথরের ওপর বসানো।
বুদ্ধমূর্তির ডানদিকে এগোতেই দেখা গেল সেই চন্দনগাছও। কিরীটী উল্লসিত কণ্ঠে বললে, সব ঠিক ঠিক মিলছে।
তারপর কাগজটা মেলে ধরে বলতে লাগল, এই লেখাগুলোর তলায় যেসব চিহ্ন আছে সেগুলো বাদ দিতে হবে, কেননা বলেছে—চিহ্ন যত বাদ গেছে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে—দশ পা পরে দুই DK..অর্থাৎ দুই দিকে তিন শূন্য বা ৩০ হাত রাস্তা আছে। হ্যাঁ। এই তো দুদিকে দুটো রাস্তা গেছে দেখছি, একটা ডাইনে, একটা বাঁয়ে। এখন…এই দু রাস্তার BAMT অর্থাৎ বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে, হাতী ০০০০ যাও। হাতী মানে গজ। চার শূন্য হল চল্লিশ, সব মিলে হল চল্লিশ গজ অথাৎ বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে চল্লিশ গজ যেতে হবে। চল এগিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতই অন্য সকলে কিরীটীর পিছু পিছু এগিয়ে চলে। ত্রিশ হাত যাওয়ার পর দেখা গেল সত্যিই দুই দিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে চল্লিশ গজ এগোবার পর দেখা গেল একটা প্রকাণ্ড পাথরের ওপর এক ছোট লোহার ড্রাগন বসানো। তার মুখে একটা লোহার বালা পরানো। কিরীটী আবার কাগজ দেখে পড়তে লাগল–
ড্রাগন দেখ বসে আছে
ধনাগারের চাবি কাছে।
মুখে তার লোহার বালা
দুলছে তাতে চিকন শলা।
হ্যাঁ, এই তো ড্রাগনের মুখে লোহার বালা। দেখ দেখ, একটা লোহার শলাও আছে!
আনন্দে উত্তেজনায় কিরীটীর সর্বশরীর থরথর করে কাঁপছে তখন। সে পুনরায় চাপা স্বরে বলতে লাগল—
দুইয়ের পিঠে শূন্য নাও
ত্রিশ দিয়ে গুণ দাও,
অর্থাৎ তাহলে হল ২০x৩০=৬০০
শূন্য যদি যায় বাদ
সেই কবারে পুরবে সাধ।
উত্তেজনায় ও অধীর আবেগে কিরীটীর সমগ্র দেহখানি কেঁপে কেঁপে ওঠে; বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে।
ছবার ড্রাগনের মুখে দোলানো লোহার বালাটা ঘোরাতেই ড্রাগনটি যে পাথরের ওপর বসানো ছিল, সেই পাথরখানি ড্রাগন সমেত সর সর করে বাঁয়ে সরে গিয়ে দু হাত পরিমাণ একটা গর্ত প্রকাশ পেল।
পেয়েছি, পেয়েছি! ইউরেকা, ইউরেকা! কিরীটী চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, সত্যি এ কি ভোজবাজি-না স্বপ্ন!
সকলেই যেন বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছে।
সেই গর্তমুখে আলো ফেলতে দেখা গেল, ধাপে ধাপে সুন্দর সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। প্রথমে কিরীটী, তারপর মিঃ সেন, সুব্রত ও রাজু পর পর সিঁড়ির পথে পা বাড়াল। পুলিস দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে রইল কিরীটীর নির্দেশের অপেক্ষায়।
গোটা পনেরো সিঁড়ি ডিঙিয়ে যাবার পরই সমতল ভূমি পায়ে ঠেকল। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সরু পথ। সেই অপরিসর পথে অতি কষ্টে দুজন লোক পাশাপাশি যেতে পারে।
কিরীটীকে মাথা নীচু করেই এগোতে হল। কিছুদূর এগোতেই অদূরে একটা আলোর ক্ষীণ রশ্মি অন্ধকারে মিটমিট করছে দেখা গেল।
এমন সময় মাটির নীচে অন্ধকার গুহার ভিতর থেকে একটা বাক-ভাঙা করুণ আর্তনাদ জেগে উঠল। সকলেই থমকে দাঁড়াল।
মনে হল এ বুঝি কোন অশরীরীর করুণ হাহাকার যুগ যুগ ধরে এই মাটির নীচে কেদে কেদে ফিরছে আজও!
অল্পক্ষণ বাদে আবার তারা এগিয়ে চলল। সকলে এসে একটা বিস্তৃত উঠোনের মত জায়গায় দাঁড়ায়। মাথার ওপরে ছাদের খিলান খুব বেশী উচু নয়।
সহসা অন্ধকারের মধ্যে ঝনঝন শব্দ শুনে সকলে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল, একটা ছোট্ট গোলাকার ছিদ্রপথ দিয়ে সর; একটা আলোর রশ্মি অন্ধকারে ছিটকে এসে পড়েছে।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সেই ছিদ্রপথে চোখ রেখে চমকে ওঠে, এ কি স্বপ্ন না সত্যি! এ যে সেই গল্পের আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপকেও হার মানিয়ে দেয়! সহসা সহস্র আরব্য রজনীর বিস্ময়কর একখানা পাতা যেন এই পাতালপুরীর আঁধারকক্ষে সত্য হয়ে এসে ধরা দিয়েছে।
আলোতে দেখা গেল ছোট একখানি ঘর। সেই ঘরের ছাদের ওপর হতে শিকলের মাথায় একটা কাঁচের প্রদীপদান ঝুলছে। সেই প্রদীপের স্বল্পলোকে দেখা যায় ঘরের চারপাশে ছোট ছোট বেতের ঝাঁপিতে ভর্তি অসংখ্য চকচকে গিনি। কে একজন আগাগোড়া কালো পোশাক-পরা লোক নীচু হয়ে এক-একটা ঝাঁপির কাছে আসছে, আর দু হাত দিয়ে সেই ঝাঁপি হতে মুঠো করে গিনি তুলে নিয়ে পরক্ষণেই মুঠো আলগা করে ধরছে—অমনি সমধুর ঝনঝন শব্দ করে সেই সব গিনি কক্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।