চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বাবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করেই হোক, যারা বাবাকে আমার এমনি করে লাঞ্ছিত করেছে তাদের আমি উপযুক্ত দণ্ড দেব।
ভাল করে খোঁজ নিয়ে শুনলাম, দত্ত আর চৌধুরী এখন দুজনেই শহরের মধ্যে বিশেষ গণ্যমান্য লোক। একজন কাঠের ব্যবসা ফেদে লক্ষপতি, অন্যজন তামাকের ব্যবসায়ে প্রায় তাই।
এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী থামল। তারপর আবার পাতা ওল্টাতে লাগল।
তারপর শুনুন। বলে কিরীটী আবার পড়তে শুরু করে : দত্তর চরম শাস্তি মিলেছে, প্রাণে মারিনি। সমস্ত ব্যবসা তছনছ করে দিয়েছি। আজ লক্ষপতি তামাকের ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত পথের ভিক্ষারী। পয়সার শোকে আজ সে পাগল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
এক নম্বর হল। এবার চৌধুরী তোমার পালা।
চৌধুরীর ভাগ্নে সনৎকে লোক দিয়ে দলে ভিড়িয়েছি। ভাগ্নে বুড়োর খুব আদরের। উঃ, বুড়ো একেবারে জলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন সনৎ অধঃপাতের পথে নেমে চলেছে। অর্থাৎ সে জানে না, এর মধ্যে আছে এক হতভাগ্যের প্রতিহিংসার চক্রান্ত। কিন্তু দিনকে-দিন এ কি হচ্ছে আমার? দুশ্চিন্তা সর্বদা যেন আমায় ভূতের মত পিছু পিছু তাড়া করে চলেছে। এ কি হল?…
ডায়েরীর আর এক জায়গায় লেখা আছে—
আরও কিছুদিন যাক। সনৎকে একেবারে পথের ধুলোয় টেনে এনে বসাই, তারপর বুড়ো চৌধুরীকে ধরব। ওকে শেষ করতে তো আমার এক মাসও লাগবে না। কিন্তু আর একজন কে? কি তার নাম, কে আমাকে বলে দেবে?
কিন্তু আমার এ কি হল? এ কি যন্ত্রণা? রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শয়তানটা যেন আমায় শত বাহু মেলে শয়তানির পথে টেনে নিয়ে চলে, কোনমতেই যেন আমি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি না।
আর এক জায়গায় লেখা–
ডাঃ চৌধুরী হঠাৎ মরে আমায় বড় ফাঁকিটাই দিয়ে গেল। আমার স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। কি করি? এখন কি করি?…কিন্তু এ কি! দুষ্কর্ম কি আমার জীবনের সাথী হয়ে দাঁড়াল নাকি? আমি কি পাগল হয়ে যাব?
ডায়েরীর আর এক পাতায় লেখা–
হ্যাঁ, সেই ঠিক হবে; যেমন করে হোক বুড়ো চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করে দিতে হবে। ওর ভাগ্নেদের পথে বসাতে হবে।
মিলেছে, সুযোগ মিলেছে। সনৎ লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে, উইলের অন্যতম উত্তরাধিকারীকে যদি কোনমতে প্রতিরোধ করতে পারি, তবে সে আমায় দশ হাজার টাকা দেবে।…
আরও এক পাতায় লেখা—
অমর বসু সব ভেস্তে দিল! শেষ পর্যন্ত কূলে এসে তরী ডোবাল, কিন্তু আমার যে সব গোলমাল হয়ে যায়! ভেবেছিলাম সনৎকে মুঠোর মধ্যে এনে ধীরে ধীরে তাকে পথের ভিখারী করে পিপড়ের মত পিষে মেরে ফেলে দেব একদিন। তা তো হল না। সব ভেস্তে গেল! এখন উপায়? মিলেছে—উপায় মিলেছে। আজ রাত্রেই সনৎকে শেষ করব।
উঃ, কী সর্বনাশ! সংবাদ পেলাম অমর বসুই নাকি বাবার ব্যবসায় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল, চৌধুরীর সহকারী হিসাবে। দাঁড়াও বসু এবারে তোমার পালা।
তারপর অনেক পাতার পরে লেখা আছে–
দলের লোকেরা আমায় জানবার জন্য কী ব্যাকুল—কী ইচ্ছুক! অমর বসুর মৃত্যুর ঘটনা খুব চাঞ্চল্য জাগিয়েছে যাহোক!
কলকাতায় যেতে হবে।
সনৎ আর সুব্রত ওদের মধ্যে যে কোন একজনকেও যদি কোনমতে এখানে এনে ফেলতে পারি তবেই কিস্তিমাত। একজন ধরা পড়লেই ওরা সব কজনই ছুটে আসবে। ধরে সব কটাকে রেঙ্গুনেই আনতে হবে—আমার মুঠোর মধ্যে।
আর এক জায়গায় লেখা–
নাঃ, কিরীটী বড় বাড়িয়ে তুলেছে! কিন্তু ভদ্রলোকের দেখছি বুদ্ধি আছে। হ্যাঁ, বলতেই হবে বুদ্ধি আছে। ঠিক আঁচ করেছে তো!
বুদ্ধির লড়াই আমার বড় ভাল লাগে। দেখি না এক চাল খেলে!
আবার এক জায়গায় লেখা–
দেখছি ধনাগারের চার্টটা চুরি গেছে।…তা যাক, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। ও তো আমি জানিই। ওটা আবার কিরীটীটাই হাত করেছে। ওটা চুরি করে আনতে হবে। রেঙ্গুনে গিয়ে চুরি করলেই হবে। ব্যস্ততার কিছু নেই।
ডায়েরীর শেষ পাতায় লেখা আছে–
টাকাকড়ি সঞ্চয় করে আমার আর কি হবে?…আমি আমার ধনাগারের সমস্ত অর্থ তাকে দিয়ে যাব—মরবার আগে যে আমার কাছে সবচাইতে বিশ্বাসী বলে মনে হবে। ও তো পাপের অর্থ, পাপের নেশায় অর্জন করা অর্থ। আমার চাই না।
ডায়েরীর সব শেষ পাতায় লেখা—
মত্যুগুহায় সনৎ ও অমরকে আটকে রেখেছি। কাল যাব মৃত্যুগুহায় রাত্রি বারোটায়। তপ্ত শলা দিয়ে অমরের চোখ কানা করব। আর সনৎকে চিরজীবনের জন্য আমার ধনাগারে বন্দী করে রেখে আসব। অর্থ-পিশাচ! দেখি আমার আজীবনের সঞ্চিত অর্থে ওর সাধ মেটে কিনা! যে সামান্য অর্থের জন্য ভাইকে মেরে ফেলতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নয়, তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। তাছাড়া আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারও শাস্তি হোক। থাকুক ও ওই রুদ্ধ ধনাগারে—যুগ যুগ ধরে অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যে বন্দী হয়ে যখের মত।
এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী ডায়েরী বন্ধ করল এবং সকলের মুখের দিকে চেয়ে বলল, আজ সেই ভীষণ রাত্রি অর্থাৎ এগারোই, এবং আজ বারোটায় হবে সেই ভীষণ পাপানুষ্ঠান।
সকলে এতক্ষণ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে কিরীটীর পড়া শুনছিল, এবার বলে উঠল, উঃ, কী ভয়ঙ্কর!
অন্ধকারে মোটর লঞ্চ ঝরঝর শব্দে জল কেটে চলেছে তখন।
কিরীটী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, তখন রাত্রি সাড়ে দশটা।…এখনও দেড় ঘণ্টা বাকি।
২১. শয়তানের কারখানা
মিয়াংয়ে এসে যখন লঞ্চ পৌছাল রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। কৃষ্ণাপঞ্চমীর চাঁদ আকাশের কোণে উঁকি দিচ্ছে।