সকলে উঠে পড়লেন।
ঘরের ওয়াল-ক্লকটা ঢং ঢং করে রাত্রি সাতটা ঘোষণা করলে।
পথে নেমে কিছুদুর এগিয়ে একসময় সলিল সেনের মুখের কাছে মুখ এনে ঈষৎ চাপা গলায় কিরীটী ডাক দিল, মিঃ সেন!
সলিল সেন ফিরে বললেন, অ্যাঁ, আমায় ডাকলেন?
হাাঁ মিয়াং এখান থেকে কত দূর হবে?
মিয়াং! বলে বিস্মিত দৃষ্টি তুলে মিঃ সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, মিয়াং। কিরীটী জবাব দিল।
সে তো অনেক দূর হবে। টোয়ান্টে খাল ধরে কুড়ি মাইল উজানে গেলে পথে পড়ে মৌবিন, আরও এগলে ইয়ান্ডুন; তারপর পড়বে ডোনাবিয়ু—তারপর হেনজাদা শহর। হেনজাদার পরেই ইরাবতী নদী। যেখানে টোয়ান্টে খাল ইরাবতীর সঙ্গে মিশেছে সেইখানেই মিয়াং শহর।…কিন্তু হঠাৎ মিয়াং সম্বন্ধে প্রশ্ন কেন মিঃ রায়?
আপনি কালো ভ্রমরকে ধরতে চান?
কালো ভ্রমর! শুনেই একরাশ বিস্ময় যেন মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে ঝরে পড়ল। তিনি যেন বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। প্রথম দু-চার মিনিট মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বেরল না।
কিরীটী চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বললে, রাত্রি এখন সাতটা কুড়ি, হাতে আর মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা সময় আছে। যেমন করেই হোক আজ রাত্রি সাড়ে এগারোটার মধ্যে মিয়াং পৌঁছতে হবে আমাদের!
কিন্তু–, মিঃ সেন কি যেন বলতে গেলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁকে একরকম বাধা দিয়েই থামিয়ে বললে, আজকের রাত যদি হারান, তবে এ জীবনে আর কালো ভ্রমরকে ধরতে পারবেন না। সে চিরদিনের মত মুঠোর বাইরে চলে যাবে। তাকে হাতেনাতে যদি ধরতে চান তো আজকের রাত পোহাতে দেবেন না!
আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না কিরীটীবাবু!
বুঝবেন, সময় হলেই সব বুঝতে পারবেন। আপনাদের দ্রুতগামী পুলিসলঞ্চ আছে না?
হ্যাঁ আছে।
এখন সেটা পাওয়া যাবে?
যাবে।
তবে চলুন, আর একটি মুহূর্তও দেরি নয়।
***
অন্ধকারে সার্চলাইট জ্বেলে পুলিস-লঞ্চখানা টোয়ান্টে খালের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।
লঞ্চে আরোহী আছে ছজন—সুব্রত, রাজু, কিরীটী, মিঃ সলিল সেন ও দুজন আর্মড বর্মী পুলিস।
কিরীটী একটা লেদার বাঁধানো ডায়েরী হাতে করে নাড়তে নাড়তে বললে, মিঃ সেন, আপনি হয়তো সমগ্র ব্যাপারটার আকস্মিকতায় আশ্চর্য হয়ে গেছেন! এই ডায়েরী পড়লেই ব্যাপারটা সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুনুন পড়ছি—
লঞ্চের কেবিনের আলোয় ডায়েরীখানা মেলে ধরে কিরীটী বললে, আমি অবিশ্যি ডায়েরীর সব কথা এখন আপনাদের পড়ে শোনাব না, কয়েকটা পাতা মাত্র পড়ব। শুনুন।
কিরীটী ছোট একখানা ডায়েরী খুলে পড়তে শুরু করল–
বাবা!—আমার স্নেহময় বাবা আর ইহজগতে নেই! বিলাত থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ সংবাদে আমার বুকখানা একেবারে ভেঙে গড়িয়ে দিলে।
তারপর বাবার ডায়েরী পড়ে বুঝতে পারলাম, বাবার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী তিনটি লোক। দুজনের নাম তাঁর ডায়েরীতেই পেলাম। তারা দুজনেই বর্মায় এখন বিপুল সম্পত্তির অধিকারী—একজন মিঃ চৌধুরী, আর একজন বিখ্যাত তামাক ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত। তৃতীয়জনের নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাবা, বিপিন দত্ত, মিঃ চৌধুরী ও আর একজন মিলে কাঠের ব্যবসা করেন। বিপিন দত্তের দুই ছেলে ও বৌ ছিল, মিঃ চৌধুরী অবিবাহিত। আমরা দুই ভাই-বোন ছাড়া বাবার আর কেউ ছিল না। বাবার ব্যবসায় উন্নতি হওয়ার আগেই মা মারা যান। বাবা ছিলেন যেমন সরল, তেমনি নিরীহপ্রকৃতির। এ জগতে কাউকেই তিনি অবিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসই তাঁর কাল হল।
মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কেমন যেন উদাস প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিলেন। এ দুনিয়ার কোন কিছুর ওপরই তাঁর আর তেমন কোন আকর্ষণই যেন ছিল না। ব্যবসা সংক্রান্ত সকল কিছুই দত্ত ও চৌধুরী তাঁর ব্যবসার অন্য দুই অংশীদার দেখাশুনা করতেন। বাবার কাছে কোন কিছুর সম্বন্ধে মত নিতে গেলে বলতেন, ওর মধ্যে আর আমায় টেনো না তোমরা, যা ভাল বোঝ তাই করগে।
আমি ছিলাম তখন বিলেতে।
দত্ত আর চৌধুরী বাবার এই উদাসীন ভাব ও একান্ত নিরপেক্ষতার ও সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভিতরে ভিতরে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র করলেন।
হঠাৎ একদিন শোনা গেল, ব্যবসার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। বাবা শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। অডিটার এল, কমিটি বসল, শেষ পর্যন্ত সত্যিই দেখা গেল ব্যবসাতে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর ডিফিসিট পড়েছে। যে ব্যবসার মূলধন মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ টাকা, সে ব্যবসায় এত বড় ডিফিসিট দিয়ে আর চলা একেবারেই অসম্ভব। অতএব ব্যবসা লালবাতি জ্বালতে বাধ্য হল।
ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্র করে দত্ত ও চৌধুরী নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়ে বাবাকে একেবারে পথে বসাল।
সরল-প্রাণ বাবা আমার। তাদের বন্ধু বলে আপনার জন বলে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই তারা তাঁকে বন্ধুত্বের ও বিশ্বাসের চরম পুরস্কার দিয়ে গেল। এ আঘাত ও অপমান বাবা সহ্য করতে পারলেন না–অসুখে পড়লেন এবং আমি ফিরে আসবার আগেই চিরনিদ্রায় অভিভূত হলেন। যাবার সময় তিনি আমার নামে একটা চিঠি রেখে যান।
সুরো বাবা আমার,
এ জীবনের শেষক্ষণে তোমায় দেখে যেতে পারলাম না, এ যে আমার কত বড় দুঃখ তা
একমাত্র ভগবানই জানেন। মনে মনে তোমার জন্য আমার শেষ আর্শীবাদ ভগবানের শ্রীচরণে
দিয়ে গেলাম। যাবার আগে তোমায় দেবার মত আর আমার বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই, তোমার
মার নামে জমানো হাজার পাঁচেক টাকা আর আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সঞ্চয় করা দুটি
কথা রেখে যাচ্ছি।
প্রথম কথা—এ দুনিয়ায় সরল বিশ্বাসের কোন দাম নেই।
দ্বিতীয় কথা—যে বিশ্বাসহন্তা, তার একমাত্র ব্যবস্থা কঠোর মত্যুদণ্ড।…
যারা তোমার বাবাকে এমনি করে পথে বসিয়ে গেল, তাদের তুমি ক্ষমা করো না।