ছোট টু-সীটার গাড়িখানি মিঃ সেনের। একজন ভৃত্য গাড়ির মধ্যে বসেছিল। সে গিয়ে ভিতরের সীটে বসল, মিঃ সেন গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন।
মিঃ সেন কিরীটীর দিকে ফিরে গুডবাই বলে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। এমন সময় গাড়ির বডির পিছনদিকটায় নজর পড়তেই কিরীটী চমকে উঠল। কারণ সে দেখলে গাড়ির গায়ে ঘষে ঘষে K অক্ষরটি তখনও স্পষ্ট রয়েছে।
বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটবার আগেই গাড়িটা সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে স্থানটা ধূমায়িত ও পেট্রলের গন্ধে ভরিয়ে দিয়ে গেটের বাইরে চলে গেছে।
সহসা কিরীটীর চমক ভাঙল ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে। ইতিমধ্যে কখন যে একসময় ডাঃ সান্যাল নীচে নেমে একেবারে ওর পাশটিতে দাঁড়িয়েছেন সে টেরই পায়নি। ডাক্তার বললেন, মিঃ রায়, আপনি যাবেন না বলছিলেন?
কিরীটী ততক্ষণে আপনাকে সামলে নিয়েছে, বললে, হ্যাঁ, এই যে যাই! বলে সে গিয়ে রাস্তায় নামল।
***
সন্ধ্যার তখন আর খুব বেশী দেরি নেই।
দিনের আলোর বিলীয়মনি রশ্মিগুলো আকাশের মেঘের গায়ে গায়ে ইন্দ্রধনু রচনা করছে।
ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিলের চারপাশে হেলানো বেতের চেয়ারে বসে সুব্রত, কিরীটী, ডাক্তার সান্যাল, রাজু ও মিঃ সলিল সেন।
কিরীটী গাইছিল—
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ঐ ছায়া
ভুলাল রে ভুলাল মোর প্রাণ!
ওপারের ঐ সোনার কলে আঁধার মূলে কোন মায়া
গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান।…
কিরীটীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর সান্ধ্য-প্রকৃতির গায়ে যেন মায়াজাল রচনা করে চলেছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সকলে শুনছে।
কিরীটী তখন গাইছে—
ফুলের বাহার নেইকো যাহার
ফসল যাহার ফলল না,
অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি পায়।
দিনের আলো যার ফুরালো
সাঁঝের আলো জ্বললো না
সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়–
ওরে আয়। আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিনের শেষে শেষ খেয়ায়—
ধীরে ধীরে কিরীটী গানটা শেষ করল।
ইতিমধ্যে ডাক্তারের ভৃত্য ভোলা এসে ঘরের বৈদ্যুতিক আলো জালিয়ে দিয়ে গেছে।
ওরা সবিস্ময়ে দেখল, ডাক্তারের দুচোখের কোলে দু ফোঁটা জল টলমল করছে।
ডাক্তার মৃদুস্বরে যেন কি বলছেন আত্মগতভাবে। তাঁর মনের মাঝে যেন বিষম ঝড় উঠেছে।
হঠাৎ একসময় ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে অশান্ত অস্থির পদে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করেন।
২০. ডায়েরী কার?
ডাক্তার! ডাক্তার!
সহসা যেন সলিল সেনের ডাকে ডাক্তারের সম্বিৎ ফিরে এল।
তিনি বললেন, না, কিছু না। মাঝে মাঝে মনটা আমার কেন যে উতলা হয়ে ওঠে বুঝি না। একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, এখনই আসছি। বলে দ্রুত পদবিক্ষেপে ডাক্তার ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
বোঝা গেল ডাক্তার তাঁর ল্যাবরেটারী ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, কারণ সে ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।
লোকটা এদিকে একেবারে চমৎকার। কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি যেন ওঁর ঘাড়ে চাপে—পাগলের মত যা-তা বকেন। অস্থির চঞ্চল হয়ে ওঠেন।…আশ্চর্য! মিঃ সেন বললেন।
রাজু বললে, মাথায় কোন গণ্ডগোল আছে বোধ হয়। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়।
কি জানি! এত বড় জ্ঞানী ডাক্তার এ শহরে আর দুজন নেই। কিন্তু লোকটা এমন খামখেয়ালী যে সন্ধ্যার পরে লক্ষ টাকা দিয়েও ডেকে পাওয়া। যায় না! সন্ধ্যা হয়েছে কি সদর দরজা একেবারে পরের দিন সকালের মত বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু গভীর রাতে গিটারের করুণ সুর-মুর্ছনা শোনা যায়। আমার মনে হয় মাথা খারাপ-টারাপ কিছু নয়, হয়তো জীবনে বড় রকমের কোন আঘাত পেয়ে থাকবেন, তারই জন্য এইরকম মানসিক অবস্থা হয়েছে।
রাত্রে কি সত্যি সত্যি ডাক্তার কোথাও বের হন না মিঃ সেন? কিরীটী শুধাল।
না। আমার সঙ্গে ওঁর আজ সাত বছরের আলাপ। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি দিনের জন্যও শুনিনি যে রাত্রে বাড়ির বাইরে গেছেন। তবে একদিন জিজ্ঞাসা করায় উনি বলেছিলেন, রাত্রে উনি নিরিবিলিতে ল্যাবরেটারী ঘরে বসে নাকি ডাক্তার সম্বন্ধে রিসার্চ করেন।
হ্যাঁ, সত্যি রিসার্চ করি।
কথাটা শুনে সকলে চমকে ফিরে দেখল খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে সহাস্যমুখে ডাক্তার সান্যাল।
ডাক্তার বলতে লাগলেন, আপনারা হয়ত জানেন টিউবারকল ব্যাসিলি বলে একরকম জীবাণু আছে, প্রতি বছর এই ভীষণ জীবাণুর প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ মত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু সভ্য সমাজই নয়, সমগ্র মানবজাতির এত বড় শত্রু আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনাদের ঐ কালো ভ্রমরের হাতে পড়লে তবুও অনেক সময় নিস্তার পাওয়া যায় শুনেছি, কিন্তু এই ভীষণ দুশমনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সত্যই বড় দুরহ ব্যাপার। কালো ভ্রমর আসে রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুপিচপি, কিন্তু এ শয়তান দিন-রাত্রি কিছু মানে না—এ তিল তিল করে মানুষের জীবন-শক্তি শুষে নেয়। আমি আজ দীর্ঘ এগারো বছর এই অদৃশ্য শত্রুর কবল থেকে রক্ষা পাবার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার জীবনের সমস্ত শক্তি তিল তিল করে এর পায়ে ঢেলে দিতে প্রস্তুত আছি। দেখি এ আমার কাছে হার মানে কিনা!
ডাক্তারের স্বরে উত্তেজনা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার আভাস ঝরে পড়ল যেন। ভাবাতিশয্যে মাঝে মাঝে তাঁর সমস্ত দেহ যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
একটু থেমে ডাক্তার আবার বললেন, কিন্তু আর নয়, আজকের মত আপনাদের কাছ থেকে আমি বিদায় চাই।