সকলেই উদগ্রীব হয়ে বনমালী বসুর দিকে তাকাল।
বনমালী বলতে থাকেন, কেন আপনাদের কাছে আসতে হয়েছে জানেন? আমার কাকা অমর বসু ছিলেন রেঙ্গুনের বিখ্যাত কাঠ-ব্যবসায়ী মিঃ চৌধুরীর ফার্মের ম্যানেজার ও প্রাইভেট সেক্রেটারী।
ছিলেন মানে?—সকলে একসঙ্গে একই প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ ছিলেন, কিন্তু এখন আর নেই। কারণ গত ৩১শে তারিখে কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হয়েছেন।
নিহত হয়েছেন! অমরবাবু! এ আপনি কি বলছেন বনমালীবাবু? সুব্রত উৎকণ্ঠিত ভাবে বলে।
বলছি যা তার মধ্যে একবর্ণ ও মিথ্যা বা তৈরী নয়। কে বা কারা যে তাঁকে হত্যা করেছে তা অবিশ্যি এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। দিন দশেক আগের এই তার আমি রেঙ্গুন থেকে পাই। এই দেখুন–বলতে বলতে ভদ্রলোক বকপকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে সকলের চোখের সামনে আলোর নীচে মেলে ধরলেন।
কাগজের ভাঁজ খুলে ধরবার সময় ভদ্রলোকের হাতের জামাটা একটু সরে যেতেই খোলা হাতের উপর সনৎ-এর নজর পড়ল মুহূর্তের জন্য। বিস্ময়ে আতঙ্কে চমকে উঠল সে, কিন্তু আর সকলে তখন সেই কাগজের লেখা গুলো পড়তেই ব্যস্ত, সেদিকে কারও নজর গেল না। কাগজে যা লেখা ছিল, তার বাংলা তজমা করলে এই রকম দাঁড়ায়–
গত শুক্রবার মিঃ চৌধুরীর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ অমর বসুকে তাঁর শয়নঘরের মধ্যে মত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। তীক্ষ্ণ ছুরি কিংবা ঐ জাতীয় কোন অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর মাথাখানি এমনভাবে বিকৃত করা হইয়াছে যে মিঃ বসুকে একেবারে চেনাই যায় না। অবশ্য মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হইয়াছে। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর মিঃ সলিল সেন তদন্তের ভার গ্রহণ করিয়াছেন। আপনি তার পাওয়া মাত্র এখানে আসিবেন।–ডি. আই. জি.।
পড়া শেষ হলে ভদ্রলোক বললেন, সেদিনকার স্থানীয় সংবাদপত্রে যে সংবাদ বেরিয়েছে তারও কাটিং যোগাড় করেছি। এই দেখুন কাটিংটায় লেখা রয়েছে–
স্বর্গীয় মিঃ চৌধুরীর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ অমর বসুর অভাবনীয় মৃত্যু।
আপনারা সকলেই জানেন, মাত্র মাসখানেক আগে মিঃ বসু মৃত মিঃ চৌধুরীর অন্যতম প্রধান সাক্ষীর কর্তব্য পালনের জন্য কিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্ৰমরের মুখের গ্রাস ছিনাইয়া লইয়া উইল-সংক্রান্ত সমস্ত গোলমাল মিটাইয়া সব কিছুর নিষ্পত্তি করিয়াছিলেন। তাঁহার সেই প্রভুভক্তি ও কর্তব্য-পরায়ণতার কথা এখনও শহরবাসী কেহই আমরা ভুলিতে পারি নাই। গতকাল তাঁহার মৃতদেহ তাঁহার শয়নকক্ষের মধ্যে পাওয়া যায়। তীক্ষ্ণ ছোরা বা ঐ জাতীয় কোন অস্ত্রের সাহায্যে মুখচোখ এমনভাবে বিকৃত করা হইয়াছে যে তাঁহাকে আর শ্ৰীযক্ত অমর বসু বলিয়া চেনাই যায় না। আগের দিন প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি অফিস-সংক্রান্ত কাজ লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। ১২টার পর তিনি শয়নগৃহে ঘুমাইতে যান এবং ঐ দেশীয় ভৃত্যও আলো নিভাইয়া দিয়া শুইতে যায়। পরদিন প্রত্যুষে ভৃত্য প্রভাতী চা লইয়া মনিবের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া মনিবের রক্তাক্ত মৃতদেহ শয্যার উপর পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া তখনই ফোনে পুলিসে সংবাদ দেয়। ইন্সপেক্টর মিঃ সলিল সেন তদন্তের ভার লইয়াছেন। কে বা কাহারা যে এইভাবে তাঁহাকে হত্যা করিয়া গেল, আজ পর্যন্ত তাহা জানা যায় নাই। তবে আমাদের মনে হয় কালো ভ্ৰমর সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ একটা মনোযোগী হইলে ক্ষতি কি!
শেষ পর্যন্ত সেই ড্রাগনের মৃতু-পরোয়ানাই সত্যি হল, একজন দুর্ধর্ষ ডাকাতের জেদই বজায় রইল!-সুব্রত বললে।
সনৎ কিন্তু একটিও কথা না বলে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।
০২. গভীর নিশীথে
এত বড় একটা দুঃখের সংবাদ সকলের মনই যেন কেমন বিষণ্ণ করে দেয়। সেই উইল-সংক্রান্ত ঘটনাটা কি আজ পর্যন্ত কেউ ভুলতে পেরেছে? ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। সুব্রত ভাবছিলঃ অজানা বন্ধু কেমন করে ছায়ার মতই পাশে পাশে থেকে সেদিন তাদের সকলকে সকল বিপদের কবল হতে আড়াল করে রক্ষা করেছিল। এক কথায় বলতে গেলে মিঃ বসু না থাকলে ঐ বিপুল সম্পত্তিপ্রাপ্তি তাদের ভাগ্যে রম্ভা-প্রাপ্তিতেই পরিণত হত।
কতক্ষণ এভাবে নীরবে কেটে গেল। সব প্রথম সনৎই সেই নীরবতা ভঙ্গ করে। বনমালীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, তা আপনি এখনও বার্মা যাত্রা করেন নি কেন বনমালীবাবু?
সনৎ-এর প্রশ্নটা শুনে বনমালী বসু যেন প্রথমটা একটা চমকে উঠলেন; কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, যাইনি তারও কারণ আছে। প্রথমতঃ সে বিদেশ-বিভুঁই মগের দেশ : কাউকে জানি না, চিনিও না কাউকে। দ্বিতীয়তঃ মশাই, সত্যি কথা বলতে কি, আমি একটা ভীত প্রকৃতির লোক। খবরের কাগজে আপনাদের কথা ও কাকার সঙ্গে আপনাদের আলাপ-পরিচয়ের কথা পড়েছিলাম এবং পরে কাকাও আমাকে আপনাদের সম্পর্কে চিঠি দিয়েছিলেন। ডি. আই. জি-র তার পাওয়ার পর প্রথমটা অনেক ভাবলাম এবং ভাবতে ভাবতে কেন জানি না, আপনাদের কথাই আমার মনে পড়ল। তার পর অনেক কম্পেট আপনাদের ঠিকানা যোগাড় করে এখানে আসছি। এখন যদি আপনাদের সহানভূতি ও সাহায্য পাই! এই পর্যন্ত বলে বনমালীবাবু থামলেন।
সনৎই আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা বনমালীবাবু, ঠিক কি ধরনের সাহায্য আপনি আমাদের কাছে। আশা করে এখানে এসেছেন বলেন তো? কারণ এক্ষেত্রে যে ঠিক কি ভাবে আপনাকে আমরা সাহায্য করতে পারি, সত্যি কথা বলতে কি, যেন ঠিক বঝে উঠতে পারছি না।