বিচিত্র এই জগৎ! আরও বিচিত্র এই জগতের মানুষ! কেন মানুষ এমনি করে অন্ধের মত ছুটে যায় সর্বনাশের পথে? অকারণে আপনাকে বিপদের মধ্যে ফেলে কেন নিজেকে করে ব্যস্ত? এও হয়তো একটা নেশা!
নেশা বৈকি। নেশা না হলে কি কেউ এমনি করে আপনাকে বিপদের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারে? সত্যি, বিচিত্র এই জগতের মানুষ! আরও বিচিত্র তার মতি-গতি।
০১. বাদল-সন্ধ্যার আগন্তুক
শীতের সকাল নয়, এবারে বাদলার রাত্রি।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। মেঘ-মেদুর আকাশের গায়ে বিদ্যতের সোনালী আলোর চকিত ইশারা উঠছে থেকে থেকে লকলকিয়ে।
মেঘনিবিড় রাত্রির অন্ধকার সচীভেদ্য। রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটার বেশী নয়।
সুব্রত, সনৎ ও রাজু পাশাপাশি তিনখানা চেয়ারের ওপরে বসে কি একটা বিষয় নিয়ে তাকে মেতে উঠেছে ঐ বাদলার সন্ধ্যারাত্রে।
রাজুর মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর ডিশে গরম গরম পাঁপর, বেগুনী ও মটরভাজা।
সুব্রত এক লাফে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে আসে। দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দোৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে, সত্যি মা, তোমাকে যে কি ভালবাসতে ইচ্ছা করছে, কেমন করে তুমি আমাদের মনের এই মুহূর্তের আসল কথাটি টের পেলে বল তো! এমন বাদলার রাতে তেলেভাজা! আমাদের এক বন্ধু কবি মণি দত্ত কবিগুরুর একটা কবিতার প্যারডি করেছিল একবার–
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব,—
পাঁপর ভাজা দিয়ে মটর সাথে নিয়ে
জিহ্বা দিয়ে শুধু অনুভব…
সুব্রতর কবিতা শুনে মা হেসে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলেও।
রাজু হাসতে হাসতেই বলে, দাদাগো, বিশ্বকবিকে আর এভাবে স্মরণ করো না। তাঁর সর্বজনপ্রিয় বর্ষা কবিতাটির এই অদ্ভুত প্যারডি শুনে, আর যাই হোক, তিনি নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবেন না তা এখন তিনি যেখানেই থাকুন।
কিন্তু এগালো যে জুড়িয়ে গেল, বেশী রাত করিস নে! আজ মটরশুঁটির খিচুড়ি হচ্ছে। মা বলেন আবার মৃদু হেসে।
সত্যিThree cheers for মা! সুব্রত বলে ওঠে। মা খোলা দরজাপথে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যান।
সকলে আহার্যে মনোনিবেশ করে।
ঠিক এমন সময় বাইরের দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ পাওয়া গেল, খুট খুট খুট।
রাজুই প্রথমে বলে, কে যেন কড়া নাড়ছে!
আবার কড়ানাড়ার শব্দ।
কে? সুব্রত উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
সুব্রত দরজাটা খালে দিল। রাস্তার অদূরবর্তী গ্যাসের আলো বৃষ্টিভেজা পিচঢালা রাস্তার ওপরে পড়ে চিকচিক করছে।
মধ্যে মধ্যে এক-এক ঝলক জলকণাবাহী হওয়া গায়ে চোখে মুখে এসে ঝাপটা দেয়। সির সির করে ওঠে সর্বাঙ্গ।
দরজার ওপরেই গায়ে বিষতি, মাথায় বর্ষা-টুপি, হাতে ঝোলানো একটি গ্র্যাডস্টোন ব্যাগ এক অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।
এইটাই কি ১৮নং বাড়ি? মিঃ সুব্রত রায়?…আগন্তুক প্রশ্ন করেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই, তা আপনি…
আমাকে চিনতে পারছেন না, এই তো? তা সে হবেখন, আপাতত আমাকে এ বৃষ্টির মধ্যে না দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিলে—
বিলক্ষণ! আসুন আসুন।
সুব্রতর আহ্বানে আগন্তুক এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই রাজু ও সনৎ ভদ্রলোকের মাখের দিকে তাকাল বিস্মিত ভাবে।
ভদ্রলোক প্রথমেই গায়ের ভেজা বর্ষতিটা খালে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে ঘরের দেওয়ালে আলনায় ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে জানালেন নমস্কার।
আগন্তুকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছিই বোধ হয় হবে, দেহের গড়ন দোহারা ও বলিষ্ঠ বলেই মনে হয়। ভদ্রলোক বেশ শৌখিন প্রকৃতির। মাথার চল কাঁচায় পাকায় মেশানো। ভ্রূযুগলের নীচে একজোড়া তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী চক্ষুতারকা। দাড়িগোঁফ নিঁখুতভাবে কামানো।
আমায় চিনতে পারছেন না আপনারা কেউই, তাই সর্বাগ্রে পরিচয়টাই দিই, আমার নাম বনমালী বসু। ডিব্রুগড় থেকে আসছি। কলকাতায় এসেছি আপনাদের কাছেই একটি বিশেষ জরুরী পরামশের জন্য। সুব্রত, রাজেন ও সনৎবাবু সকলের নিকটই আমার বক্তব্য আমি পেশ করব। কিন্তু তারও আগে যদি এক কাপ চা পেতাম! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শরীর যেন একেবারে অবশ হয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই, এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এত কুণ্ঠা বোধ করছেন কেন? বলে তখনই সুব্রত ভৃত্যকে ডেকে এক কাপ চা আনতে দিল।
কিছুক্ষণ পরে চা এলে, গরম চায়ের কাপে চমক দিতে দিতে ভদ্রলোক বললেন, শোনা যায় সত্যযুগে অতিথি-সৎকার করা গৃহস্থের একটা প্রধান ও অবশ্য-করণীয় ধর্ম ছিল আর আজকাল ভিখারী ও প্রার্থীকে বাড়ি হতে তাড়িয়ে দেওয়াটাই হয়েছে একটা রীতি!
রাজু প্রতিবাদের সরে বলল—হ্যাঁ, তার কারণও আছে। আজকাল সকলেই ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ লাভ করতে চায়। পরের মাথায় যে যত সুন্দরভাবে হাত বুলাতে পারে তারই জয়জয়কার।
তা যা বলেছেন। বলতে বলতে ভদ্রলোক নিঃশেষিত চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন।
বাইরে আবার জোরে বণ্টি নামল। সোঁ সোঁ করে হাওয়া বইতে শুরু করল।
আপনি কেন হঠাৎ এই ঝড়-বাদলের রাত্ৰে ডিব্রুগড় থেকে এত দূর আমাদের কাছে এলেন তা তো কই শোনা হল না বনমালীবাবু এখনও? সুব্রত প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, সে-কথাই এবারে বলব। বলতে বলতে ভদ্রলোক একটা নড়েচড়ে বসে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আরম্ভ করলেনঃ তা হলে খালেই বলি কথাটা সুব্রতবাব, যে জন্যে এতদার ছুটে এসেছি তাই বলছি। একটা বিশেষ দভাবনায় পড়েছি মশাই।