কিরীটীর কথায় রাজু ও সুব্রত চমকে উঠে বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে শুধাল, সে কি!
হ্যাঁ। কাল রাত্রে সামান্য একটু ভুলের জন্য তাঁকে সেই শয়তানের আড্ডায় ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত আছি।
কি?
তাঁকে তারা প্রাণে মারবে না।
তাদের আপনি চেনেন না মিঃ রায়। এ সংসারে তাদের অসাধ্য কিছুই নেই। এমন কোন পাপ কাজ বা দুষ্কর্ম নেই যা ওদের বিবেকে বাধে। ওরা নেকড়ের চেয়েও হিংস্র, সাপের চেয়েও খল।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। পরে গভীরভাবে বললে, কিন্তু এক্ষেত্রে মেরে ফেললে যে ওদের কাজ হাসিল হবে না সুব্রতবাবু। যে ফাঁদ ওরা পাততে চায় সে বড় বিষম ফাঁদ। কিন্তু ওদের হিসাবেই সামান্য একটু ভুল হয়ে গেছে এবং সেইটকু শুধরে নেওয়ার জন্য ওরা বোধ হয় সনৎবাবুকে নিয়েই কালকের জাহাজে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রেঙ্গুন রওনা হবে, এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একে একে গতরাত্রের সমস্ত ঘটনাই আগাগোড়া খুলে ওদের বলে গেল।
সুব্রত কিরীটীর মুখে গতরাত্রের আনুপূর্বিক কাহিনী শুনে বললে, তা হলে দেখছি সত্যসত্যই আপনি ভাগ্যবান। প্রথম যাত্রাতেই মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ মিলে গেল!
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, না, এবারেই প্রথম সাক্ষাৎ নয়। ইতিপূর্বে আরও একবার দর্শন মিলেছিল।
সে কি! দুজনেই একসঙ্গেই প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, খোঁড়া ভিক্ষুকই স্বয়ং মহাপ্রভু। বলে আবার কিরীটী খোঁড়া ভিক্ষুকের কাহিনীটাও ওদের বললে।
ট্যাক্সি ছুটে চলেছে চীনাপট্টির উদ্দেশে। রাজপথে অসংখ্য লোক। পিপীলিকার সারির মত যে যার গন্তব্যপথে চলেছে। অফিস টাইম। বাসট্রামগুলো যাত্রীতে যেন একেবারে ঠেসা।
কিরীটী বললে, একটা কথা ভাবছি, চীনাপট্টিতে হুট করে গিয়ে আগেই ওঠা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আটঘাট বেধে কাজে নামতে হবে।
কি করবেন তাহলে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
আমরা প্রথমে লালবাজারে যাব, সেখানে চৌধুরী বলে একজন সি. আই. ডি, ইন্সপেকটারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ-পরিচয় আছে। তাকে সব কথা খুলে বলে লালপাগড়ির সাহায্য নিতে হবে।
লালপাগড়ি!
হ্যাঁ, জানেন না তো, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা মহলে লালপাগড়ির মহিমা অপরিসীম।
লালবাজারের কাছাকাছি এসে ওরা ট্যাক্সিটা বিদায় করে দিল ভাড়া মিটিয়ে।
চৌধুরী অফিসেই ছিল। কিরীটী তাকে সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলবার পর চৌধুরী সানন্দে কিরীটীকে সাহায্য করতে রাজী হয়ে গেল। এবং চৌধুরীর নির্দেশমত তখনই থানা থেকে দুজন কনস্টেবল কিরীটী তার সাহায্যের জন্য পেল।
থানা থেকে বের হয়ে কিরীটী সদলবলে যখন হংকং সু ফ্যাক্টরীর সামনে এসে হাজির হল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।
দোকানের ঠিক সামনে একজন প্রৌঢ়বয়সী চীনা একটা কাঠের টুলের ওপরে বসে একটা লম্বা পাইপ মুখে গুজে ঝিমোচ্ছিল। ওদের জুতোর শব্দে লোকটা হঠাৎ চমকে মুখ তুলে তাকাল এবং পরক্ষণেই সাদরে আহবান জানাল, জুতি সাব! আচ্ছা জুতি!
দোকানের ভিতরে একটি অল্পবয়সী চীনা যুবতী কাঁচি দিয়ে চামড়া কাটছিল আর মেসিনে বসে একজন আধ্যবয়সী চীনা যুবক কি যেন সেলাই করছিল।
কিরীটীদের সকলকে দোকানে প্রবেশ করতে দেখে ওরা দুজনেই মুখে তুলে একবার মাত্র চেয়ে আবার যে যার কাজে মন দিল। দোকানটি যে খুব বড়গোছের তা নয়।
নাতিপ্রশস্ত একখানা হলঘর। ওপরে প্ল্যাটফরমের মত কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। একপাশে পুরানো চামড়ার টুকরো স্তুপাকার করে রাখা হয়েছে। অন্য একপাশে দেখা যায় ওপরে ওঠবার জন্য একটা কাঠের সিঁড়ি। কিরীটী তার খরসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে চারিদিকে ভাল করে দেখতে লাগল।
কনস্টেবল দুজন কিরীটীর নির্দেশেই দোকানের ভিতর ঢোকেনি। তারা ওদিককার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
কি জুতি চাই বাব?—প্রশ্ন করলে চীনা যুবকটি আধো আধো বাংলায়।
কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা তোমাদের দোকানঘরটা একবার সার্চ করব বলে এসেছি।
কথাটা শোনামাত্র চীনা যুবকটি মেশিন ছেড়ে উঠে এল এবং বেশ পরিষ্কার ইংরাজীতে শুধাল, কেন, কি কারণে জানতে পারি কি?
কিরীটী দোকানের ভিতর চারিদিকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে করতে উদাস স্বরে জবাব দেয়, সরকারের হকুম।
চীনা যুবক রুক্ষ স্বরে জবাব দিল, তোমার ও হকুম আমি মানি না বাবু। এখনই তুমি আমার দোকান থেকে বেরিয়ে যাও, তা না হলে বিপদে পড়বে।
কিরীটী গভীরভাবে জবাব দেয়, বিপদে আমি পড়ব না, আমায় না দেখতে দিলে তুমিই বিপদে পড়বে সাহেব।
ইতিমধ্যে ওদের কথা-কাটাকাটির আওয়াজ পেয়ে পাশের একটা দরজা খুলে আরও দুজন হোমরাচোমরা গোছের চীনা বেরিয়ে এল। তারা বললে, কি হল বাবু?
কিরীটী ওদের দিকে একান্ত তাচ্ছিল্যভরে চেয়ে জবাব দিল, এই দোকানটা একবার আমরা ভাল করে দেখতে চাই।
কেন? রুক্ষ স্বরে একজন প্রশ্ন করে।
কিরীটী যেন ওদের ভ্রুক্ষেপমাত্রও না করে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন সুব্রতবাবু, আমরা আমাদের কাজ করি।
কিরীটীর মুখের কথা শেষ হল না, চোখের পলকে ওদের একজন সুব্রতর সামনে এসে দাঁড়াল এবং মুহূর্তে সেই পরিষ্কার দিবালোকেই একখানা সুতীক্ষ্ণ বাঁকানো ছুরি ওদের গতিপথ রোধ করে।
১১. কালো ভ্রমরের হূল
চোখের পলক ফেলার আগেই কিরীটী চীনা লোকটির ছুরিসমেত হাতখানা ধরে এক হেচকা টানে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কনুইটা চেপে ধরে লোকটার হাতটা মুচড়ে দিল।