সরত ও রাজ, নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিল বটে, কিন্তু কিরীটী তাদের খোঁজ করলে না। সম্ভবতঃ নিদারুণ পরিশ্রমে এবং বারংবার আক্রান্ত হয়ে সেসব কথা চিন্তা করবারও বুঝি তার দেহের বা মনের অবস্থা ছিল না।
বড় রাস্তার ওপরে এসেই প্রথমে সে রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, মাথাটাও গুর পরিশ্রমে ঝিমঝিম করছে তখন।
১০. অনুসন্ধান
রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা।
বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে শুধ, দু-একটা মোটরগাড়ির হর্ন কিংবা রিকশার ঠং ঠং আওয়াজ পাওয়া যায়।
জনহীন শহরে যেন ক্ষীণ প্রাণস্পন্দন।
দোকানপাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দু-একটা জুতোর দোকান তখন অবিশ্যি খোলা। কোন দোকানে খদ্দের নেই, কেবল দোকানে ক্যাশিয়ার খাতার ওপর ঝুকে পড়ে সারা দিনের বেচাকেনার জমাখরচ ঠিক করছে। এক দোকানের পাশে কয়েকটি চীনা জটলা পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করছে।
একটা তেতলা বাড়ির নীচে বাঁধানো রোয়াকে কতকগুলো ভিখারী জড়ো হয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। তাদের কেউ কেউ আবার দেয়াল থেকে প্ল্যাকার্ড ছিড়ে নিয়ে শোবার ব্যবস্থা করছে।
কিরীটী সে-সব দিকে লক্ষ্য না করে এগিয়ে চলল। লালবাজার থানাটা ছাড়িয়ে একট, এগিয়ে এসেই কিরীটী কি ভেবে দাঁড়াল।
একখানা ট্যাক্সি সেদিকে আসছে। ট্যাক্সিটাকে হাত-ইশারায় দাঁড় করিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বললে, টালিগঞ্জ–
ক্লান্ত অবসন্ন কিরীটী চলমান ট্যাক্সির নরম গদিতে গা এলিয়ে দেয়।
ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে-মুখে এসে যেন শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যায়। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে টালিগঞ্জের দিকে।
নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি।
মাথার ওপরে সীমাহীন কালো আকাশ যেন সর্বাঙ্গে তারার রত্নখচিত ওড়না জড়িয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন।
চৌরঙ্গীর দীপমালা-শোভিত পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি বেগে ছুটে চলেছে। গাড়ির সীটে দেহভার এলিয়ে দিয়ে কিরীটী চোখ বুজে পড়ে থাকে।
বাড়িতে পৌঁছে কড়া নাড়তেই জংলী এসে দরজা খুলে দেয়। ট্যাক্সির ভাড়াটা দিয়ে দেয় জংলী।
ভাড়া মিটিয়ে ওপরে এসে জংলী দেখে কিরীটী একটা সোফয়ি হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। জংলী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কিরীটীর জামায় রক্ত দেখে সবিস্ময়ে বলে, ও কি বাবুজি, এমন করে জখম হল কি করে বাবুজি!
পিছন হতে অন্ধকারে ছুরি মেরেছে রে! তুই এক কাজ কর—ইলেকট্রিক স্টোভে খানিকটা জল গরম করে নিয়ে আয়। আর ঐ পাশের ঘরের সেলফে আইডিন আর তুলে আছে, নিয়ে আয়।
জখম খুব গুরতর হয়নি। ক্ষতস্থান বেশ ভাল করে চেপে বেধে দিয়ে জংলী কিরীটীকে হাত ধরে এনে শয্যায় শুইয়ে দিল। ফাস্ট এইড দেওয়া কিরীটীর নিকটেই জংলীর শিক্ষা।
পরের দিন সকালে যখন কিরীটীর ঘুম ভাঙল তখন ভোরের সোনালী রোদে সুনীল আকাশ যেন ঝকঝক করছে। খোলা জানালা দিয়ে খানিকটা প্রভাতী রোদ পায়ের ওপর এসে পড়েছে। বারান্দায় খাঁচায় পোষা ক্যানারী পাখিটা থেকে থেকে শিস দিচ্ছে। বাগানে বোধ হয় রজনীগন্ধা তার মধুর মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।
কিরীটীর গা-হাত-পায়ে অল্প অল্প বেদনা আছে, মাথাটাও যেন একটু ভারী-ভারী মনে হয়। শয্যার উপর চোখ বুজে শুয়েই কিরীটী গতরাত্রের সমস্ত কথা আগাগোড়া একবার ভাববার চেষ্টা করে। গতরাত্রের দুঃসাহসিক অভিযানের ব্যাপারটা এখনও মনের উপর ছায়াবাজির মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
নিঃশব্দে জংলী এসে ঘরে প্রবেশ করে। বললে, বাবুজি! তবিয়ত আচ্ছি হ্যায় তো?
হ্যাঁ, বহুৎ তন দুরস্তি মালুম হোতা, এক কাপ চা নিয়ে আয় তো বাবা! শয্যা ত্যাগ করে কিরীটী বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করল।
মুখ হাত ধুয়ে মাথাটা বেশ করে জলে ভিজিয়ে, স্নানের ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে শিস দিতে দিতে কিরীটী বসবার ঘরে এসে ঢুকতেই সুব্রত ও রাজুকে সেখানে বসে থাকতে দেখল। অভ্যর্থনার পরে হাসতে হাসতে বলে ওঠে, সুপ্রভাত—সুপ্রভাত! কতক্ষণ এলেন?
অল্পক্ষণ। তারপর কেমন আছেন? শুনলাম কাল রাত্রে নাকি হাতে জখম হয়েছেন। প্রশ্ন করে সুব্রত।
হ্যাঁ, ও কিছু নয়। চলুন চা-পর্বটা শেষ করে একবার কালকের আড্ডাটায় হানা দিয়ে আসা যাক, যদি কিছুর সন্ধান মেলে।
তাতে কি কোন ফল হবে, আপনি মনে করেন? বলা যায় না, তাছাড়া যদি—
সুব্রত ও রাজু, কিরীটীর কথায় হো হো করে হেসে উঠল। সুব্রত বলল, —যদি কি? যদি একপাটি ছেড়া জুতো বা একটা ভাঙা ছুরির বাঁট নিদেনপক্ষে দেওয়ালের গায়ে একটা হাতের ছাপ পাওয়া যায়?
কিরীটী ওদের কথার ভঙ্গিতে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। বললে, হ্যাঁ, ডিটেকটিভরা নাকি ঐ সব সুত্র ধরেই অনেক সময় বড় বড় পাপানুষ্ঠানেরও কিনারা করে ফেলেন শুনতে পাওয়া যায়।
জংলী এসে চায়ের ট্রে হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। এবং সামনের পিয়ের ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।
চা-পানের পর তিনজন রাস্তায় এসে নামল।
এর মধ্যেই বাইরে রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে তিনজনে উঠে বসল।
একসময় কিরীটী বললে, আমরা তো কালই রওনা হচ্ছি! কি বলেন, সুব্রতবাবু?
হু। কিন্তু সনৎদার কোন একটা কিনারা তো হল না এখনও! বললে সুব্রত।
সনৎবাবু আপাততঃ কলকাতাতেই আছেন।