কিরীটী অতি সন্তর্পণে দেওয়াল ঘেষে ঘেষে এগিয়ে চলল। আগের লোকটাকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বামে সব দিকেই অন্ধকার। অন্ধকার যেন স্তরে স্তরে জমাট বেধে উঠেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার গলির মধ্যে বুঝি বাতাসও আসতে ভয় পায়। কিরীটী বুঝল, আর এগিয়ে চলা বৃথা, তাই দাঁড়িয়ে রুদ্ধনিঃশ্বাসে কান পেতে রইল। হঠাৎ একসময়ে একটা আওয়াজ কানে এল খটখটখট। .
তারপরই খানিকক্ষণ চুপচাপ, আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। আবার শব্দ হল-খট-খটখট।
এবার যেন কাছেই কোথায় একটা দরজা খোলার শব্দ হল। অন্ধকার গলিপথে একটা ম্লান আলোর শিখা দেখা গেল। তার পরেই ঈষদুন্মুক্ত একটা দরজাপথে একটা কুৎসিত চীনা বুড়ীর চেপ্টা মুখ দেখা গেল। হাতে তার কেরোসিনের বাতি। বাতিটা যেন আলোর চাইতে ধূমোদগিরণই বেশী করছে।
বুড়ী বাতিটি লোকটির মুখের উপর তুলে ধরল। অমনি লোকটা বাঁহাতের দুটো আঙুল কোণাকুনি করে দেখালে। সেই বিশ্রী বুড়ীটার কুৎসিত মুখে ততোধিক কুৎসিত এক টুকরো হাসি জেগে উঠল। বুড়ী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াল।
লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। মুহূতে কিরীটী নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে নেয়, এবং ত্বরিৎপদে গলির ভিতর থেকে বের হয়ে গিয়ে সুব্রত যেখানে অপেক্ষা করছিল সেখানে এসে বললে, এখনই আপনি বাড়ি যান সুব্রতবাব এবং যত শীঘ্র পারেন রাজেনবাবুকে নিয়ে এখানে চলে আসবেন। ঐ যে দেখছেন, হংকং সু ফ্যাক্টরীর পাশ দিয়ে একটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওরই আশে-পাশে কোথাও অন্যের সন্দেহ বাঁচিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। একেবারে শূন্য হাতে আসবেন না।
কি হাতিয়ার সঙ্গে আনি বলুন তো? সব্রত প্রশ্ন করে।
একটা ছুরি বা একটা অন্ততঃ লোহার রড হলেও চলবে। ব্রিটিশ রাজত্বে তো আর পিস্তল বা রিভলবার চট করে পাওয়া যাবে না। কাজে কাজেই আমাদের ভগবানপ্রদত্ত বুদ্ধিকেই কাজে লাগাতে হবে।
সুব্রত হেসে ফেলে।
হাসছেন সুব্রতবাবু! প্রায় পৌনে দুই শত বৎসরের পরাধীনতায় আমরা যে একেবারে পঙ্গু ও অথর্ব হয়ে আছি। কিন্তু থাক, সে-সব কথা, পরাধীন দেশের দুঃখের শেষ কোথায়! হ্যাঁ শুনুন, আপনি আর রাজেনবাবু এসে ঐ হংকং সু ফ্যাক্টরীর কাছে অপেক্ষা করবেন, পর পর দুটো বাঁশীর আওয়াজ পেলেই ঐ গলির মধ্যে ছুটে যাবেন। বাঁশীর আওয়াজ না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না। আচ্ছা আমি চললাম।
কিরীটী কথাগুলো বলে দ্রুতপদে গলির মধ্যে অদশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
সুব্রত আর ক্ষণমাত্র দেরি না করে, সামনেই একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট!
ট্যাক্সি নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলল।
এদিকে গলির মধ্যে ঢুকে কিরীটী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবলে, তারপর আঁধারে আন্দাজ করে ক্ষণপূর্বের দেখা সেই দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূত মাত্র চিন্তা করে টক-টক-টক করে দরজার গায়ে তিনটে টোকা দিল।
কিন্তু কোন সাড়া নেই। অল্পক্ষণ পরে আবার টোকা দিল—টক-টক-টক।
এবারে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল এবং পরক্ষণেই দরজাটা খুলে গেল। আগের সেই চীনা বুড়ী বাতি হাতে বেরিয়ে এল।
কিরীটী আঙুল দিয়ে পূর্বের লোকটির মত ইশারা করতেই বুড়ী পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। সে বাড়ীর পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল তখন।
সরু একটা অত্যন্ত স্বল্পপরিসর অন্ধকার গলিপথ বরাবর খানিকটা চলে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে বাড়ী আলো নিয়ে এগিয়ে চলে আর কিরীটী পিছন পিছন চলে।
কিছুদূর অগ্রসর হতেই আচমকা কিরীটী হঠাৎ দুই হাত দিয়ে পিছন থেকে বুড়ীর মুখটি চেপে ধরল এবং ক্ষিপ্রহস্তে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বুড়ীর মুখে গুজে দিল; তারপর সিল্ক কর্ড দিয়ে বুড়ীকে বেধে ফেললে।
০৮. চীনা আড্ডায়
বুড়ীকে বাঁধতে কিরীটীর দুমিনিটও সময় লাগে না।
বুড়ীকে বেধে ফেলে কিরীটী উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। জাপটে ধরবার সময় বুড়ীর হাতের বাতিটা ছিটকে পড়ে নিভে গিয়েছিল। কিরীটী পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা জালাল; তারপর সেই অন্ধকার গলিপথ দিয়ে খানিকটা অগ্রসর হতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের দরজার পাশে টুলে বসে একটা চীনা যুবক, ঝিমুচ্ছে। দেওয়ালে একটা ওয়াল-ল্যাম্প পিটপিট করে জলছে। তারই প্লান আলো তন্দ্রাচ্ছন্ন চীনাটির মুখের উপর এসে পড়েছে। লোকটা কিছুই টের পায়নি তাহলে। সামনের ঘরের দরজাটা ভেজানো। ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কথাবার্তার দু-একটা টুকরো আওয়াজ শোনা যায়। কিরীটী একেবারে দেওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। তারপর চীনা লোকটির কাছাকাছি এসে হঠাৎ পিছন দিক থেকে দুহাত দিয়ে খুব জোরে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
আধো ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে লোকটি যেমন চমকে উঠেছিল তেমনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল এবং সেই অবস্থাতেই লোকটাকে জাপটে ধরে মাটিতেই গড়িয়ে গড়িয়ে খানিকটা পিছন দিকে চলে এল কিরীটী।
অতর্কিত আক্রমণে চীনা লোকটা প্রথমটা বিশেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল সত্যিই, কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সে কিরীটীর বাহু বেষ্টন থেকে ছাড়াবার জন্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু কিরীটীর দৈহিক শক্তির কাছে পেরে ওঠে না। এবং পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।