মৃদু হেসে ব্রাহ্মণোচিত গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে কিরীটী রায় বলল, বৎস, তোমার কল্যাণ হোক। ক্ষণেক অপেক্ষা কর। তারপর কি মনে করে বললে, হ্যাঁ ভাল কথা, আপনাদের পা-গাড়ি আছে?
হ্যাঁ আছে, কেন বলুন তো?
আপনি বাইকটা নিয়ে, বড় রাস্তাটা যেখানে ট্রাম রাস্তার গায়ে গিয়ে মিশেছে সেখানে অপেক্ষা করবেন। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে যাব। বলতে বলতে কিরীটী রায় ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।
রাস্তায় নেমে কিরীটী ধীরে ধীরে লাঠি হাতে গলির পথ দিয়ে এগোতে থাকে।
রাত্রি তখন সাতটার বেশী হবে না। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরগাড়ি রাস্তা দিয়ে হস, হস, শব্দে ছুটে যাচ্ছে। দু-একটা রিকশার মৃদু ঠুং-ঠাং আওয়াজ শোনা যায়। সামনেই একটা মস্তবড় ফটকওয়ালা বাড়িতে কোন উৎসব হচ্ছে বোধ হয়। রকমারী আলোতে আর লোকজনের গোলমালে বাড়িটা সরগরম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি নানা রংয়ের ও নানা আকারের মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে।
কিরীটী এগিয়ে চলে।
খোঁড়া ভিক্ষুকটা তখনও চেচাচ্ছে বাবা গো! এই খোঁড়া ভিখারীকে একটি আধলা দাও বাবা। কত দিকে, কত ভাবে, কত পয়সা নষ্ট হয় বাবা গো। দয়া কর মাগো জননী।
কিরীটী একটা পয়সা হাতে নিয়ে ভিক্ষুকের দিকে এগিয়ে বলল, এই নে, পয়সা নে।
ভিক্ষুক বা হাতটা বাড়িয়ে দিল। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী ভিক্ষুকটাকে দেখে নিয়ে পয়সাটা ভিক্ষুকের হাতে ফেলে দিল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
ভিক্ষুক তখনও একই ভাবে চেচিয়ে চলেছে। হঠাৎ কিরীটী দেখলে আর একজন ভিক্ষুক যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে উলটো দিক থেকে ওদিকেই আসছে।
কিরীটী চলার গতিটা একটু শ্লথ করে দিল এবং আড়চোখে ভিক্ষুকটাকে লক্ষ্য করতে লাগল দূর থেকেই।
দ্বিতীয় ভিক্ষুকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে আগের ভিক্ষুকটার কাছাকাছি আসতেই দুজনে ফিস ফিস করে কি যেন বলাবলি করতে লাগল পরস্পরের মধ্যে।
কিরীটী আর অপেক্ষা না করে পা চালিয়ে চলল বড় রাস্তার মোড়ের দিকে এবারে।
মোড়ের পানের দোকানটার কাছে এক হাতে বাইক ধরে সুব্রত একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু অনভ্যাসের দরুনে মাঝে মাঝে কাশিতে তার দম আটকে আসতে চায়।
কিরীটী সুব্রতর কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর সুব্রতর হাত থেকে বাইকটা নিয়ে বাগিয়ে ধরতে ধরতে তাড়াতাড়ি বললে, ট্রামে চেপে লালবাজারের মোড়ে চলে যান সোজা। সামনেই যে রাস্তাটা বরাবর নয়া রাস্তায় মিশেছে, তার দুপাশে চীনাদের জুতোর দোকান আছে, ঐখানেই আমি যাচ্ছি। একটা ছুরি, সিল্ক কর্ড ও একটা টর্চ নিতে ভুলবেন না যেন।
কথাগুলো বলেই কিরীটী একলাফে বাইকে চেপে সজোরে প্যাডেল করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটীর নির্দেশমত তখনই সুব্রত ক্ষিপ্রপদে বাড়ির দিকে চলে গেল।
কিছুদূর এগিয়ে কিরীটী রাস্তার মোড়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। সহসা একসময় তার নজরে পড়ল দ্বিতীয় খোঁড়া ভিক্ষুকটা ঐদিকেই আসছে।
মহাপ্রভু নিশ্চয়ই এতক্ষণ যাত্রা করেছেন! কিরীটী বাইকে চেপে গলির দিকে চলল এবারে। কাছাকাছি আসতেই ক্রিং ক্রিং আওয়াজ পাওয়া গেল এবং পরক্ষণেই গলির মুখ দিয়ে একজন সাইকেল-আরোহী দ্রুত বেরিয়ে এল।
লোকটার পরনে ঢিলা পায়জামা, গায়ে ঢোলা কালো জামা, মাথায় কালো টুপি-কপাল পর্যন্ত টেনে দেওয়া হয়েছে; চোখে কালো কাঁচের গগলস।
গলিপথ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে লোকটা ট্রাম রাস্তার দিকে সাইকেল চালাতে লাগল। কিরীটীও তার পিছু পিছ সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করলে।
লোকটা সোজা আমহার্স্ট স্ট্রীট দিয়ে বৌবাজার স্ট্রীটে পড়ে বরাবর গিয়ে চিৎপুরে পড়ল।
দুপাশে যত সব ছবি আর আয়নার দোকান। কাঁচের গায়ে গায়ে উজ্জল বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মিগুলি প্রতিফলিত হয়ে বিচিত্র রঙের রামধনু জাগিয়েছে।
রাত্রি কতই বা হবে! বড় জোর আটটা, তার বেশী নয়। কলকাতা শহরে সন্ধ্যা বললেই চলে। দোকানে লোকের ভিড়। পথে ট্রামে ঢং ঢং ঘণ্টার আওয়াজ আর রিকশাওয়ালাদের ঠং ঠুং শব্দ ও মোটরের হন।
লোকটা যে একজন পাকা সাইকেল-চালিয়ে, তা ওর গতি দেখেই বোঝা যায়। লোকটা অতি দ্রুত ভিড় বাঁচিয়ে লালবাজার ডাইনে ফেলে সোজা চীনাপট্টির মধ্যে ঢুকল।
রাস্তার দুপাশে সারি সারি চীনাদের জুতার দোকান। মোড়ের একটা লাইটপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সুব্রতকে দেখতে পেল কিরীটী।
সাইকেল চালিয়ে কিরীটী সুব্রতর পাশে এসে নামল।—যে লোকটিকে এতক্ষণে কিরীটী অনুসরণ করছিল, সে তখন খানিকটা দূরে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল হাতে করে এগোচ্ছিল।
এটা নিয়ে এখানে অপেক্ষা করুন। এই বলে কিরীটী বাইকটা সুব্রতর হাতে দিয়ে লোকটিকে অনুসরণ করল তাড়াতাড়ি। লোকটি বাইক নিয়েই সামনের অন্ধকার গলিটার মধ্যে গিয়ে পড়ল। কিরীটীও আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে শিকারী বিড়ালের মত লোকটাকে অনুসরণ করল।
গলিটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই ঠাওর করা যায় না। দুপাশে বাড়ির খাড়া দেওয়াল উঠে গেছে। হাত দশেক উচুতে একটা জানালার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এসে গলির অন্ধকারে ছিটকে পড়েছে যেন। অন্ধকার এত বেশী যে পাশের লোক পর্যন্ত নজরে আসে না। পচা মাছ ও চামড়ার বিশ্রী গন্ধে দম বন্ধ হবার যোগাড়।