ঐ সময় আবার সহসা পূর্বের সেই গোঙানির শব্দটা শোনা গেল। জগন্নাথ এবারে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে বললে, এই, বল!
লোকটি তথাপি নীরব। সে আগের মতই বোকা-চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে।
না, এর কাছ হতে জবাব পাওয়া যাবে না দেখছি। জগন্নাথ মনে মনে বললে। তারপর সে একটা রুমাল বের করে লোকটার মুখ চেপে বেধে দিল, যাতে করে লোকটা চিৎকার বা কোন শব্দ করলেও কেউ শুনতে না পায়।
থাক বেটা, যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর। বলতে বলতে জগন্নাথ ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে থেকে ঘরের শিকলটা তুলে দিল।
অন্ধকার বেশ জমাট হয়ে উঠেছে। দেওয়ালের কোন ফাটলে বুঝি একটা ঝিঁঝি পোকা ঝিঁঝি করে একটানা বিশ্রী শব্দে ডেকে চলেছে তো চলেছেই।
০৭. খোঁড়া ভিক্ষুক
বাইরের অন্ধকার বারান্দায় এসে জগন্নাথ হাতের টর্চটা টিপতেই দেখলে, উপরেও নীচের তলার মতই বারান্দার গায়ে পর পর চার-পাঁচটি ঘর। উঃ, কি নিস্তব্ধ! সারা বাড়িটা মত্যুর মতই বিভীষিকাময় যেন। মনটা সত্যি কেমন যেন সিরসির করে ওঠে। আশঙ্কায় থমথম করে। বারান্দায় কতকালের ধুলো যে পড়তে পড়তে জমে উঠেছে তার ঠিক নেই।
জগন্নাথ টর্চ হাতে একে একে উপরের সব ঘরগুলোই পরীক্ষা করে দেখলে, কিন্তু কোন ঘরেই জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই। যুগ যুগ ধরে যেন এখানে কেউ বাস করেনি। কারও পায়ের স্পর্শও যেন পড়েনি।
কই, কেউ তো এখানে নেই। তবে কার অস্ফুট কাতর শব্দ কানে আসছিল? কে অমন করুণ স্বরে গোঙাচ্ছিল? মনে মনে বলতে বলতে জগন্নাথ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে একসময় ছাদে গিয়ে উঠল। ছাদও নির্জন জমাট আঁধারে থমথম করছে।
উপরে তারায় ভরা কালো আকাশ। সামনেই চোখে পড়ে সেই পোড়ো মাঠটা। সেটাও রাতের আঁধারে অস্পষ্ট আবছা হয়ে উঠেছে। ওদিকটার তালগাছটার পাতায় পাতায় নিশীথের হাওয়া কেমন একরকম সিপ, সিপ শব্দ তুলেছে।
ছাদে মাত্র চিলেকোঠা। সে ঘরের দুটো কপাটই খোলা, হাওয়ায় মাঝে মাঝে ঢপ ঢপ করে বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আর কেউ নেই।
জগন্নাথ নীচে নেমে এল আবার। নীচের তলার ঘরগুলো আর একবার ভাল করে দেখল। কিন্তু বৃথা। সেখানেও কিছু পাওয়া গেল না। আর তো দেরি করা সঙ্গত নয়, যদি দলের কেউ আবার এসে পড়ে! অতঃপর জগন্নাথ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল।
গলিটা এর মধে বেশ নির্জন হয়ে উঠেছে। জগন্নাথ সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে গলিপথ ধরে এগোতে লাগল।
গলিটা যেখানে এসে বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে, সেখানে গ্যাস-পোস্টের নীচে মৃদু আলোয় একজন খোঁড়া ভিক্ষুক-শ্রেণীর লোক লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে পথিকের করুণা ভিক্ষা করছে : বাবু গো, দয়া করে এই খোঁড়াকে একটি পয়সা দিয়ে যান। কত দিকে কত পয়সা আপনাদের যায়, মা জননী গো!
জগন্নাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিক্ষককে দেখতে লাগল। তার মনে সহসা জাগে, কে-কে এই ভিক্ষুক? কোথায় যেন ওকে দেখেছে। কোথায়?
জগন্নাথ চিন্তা করতে লাগল এবং চিন্তা করতে করতেই একসময় তার মনে হয়, লোকটাকে সে সেদিনই দেখেছে। ঐ পোড়ো বাড়িতে লোকটাকে দেখেছে সে। বগলে ক্রাচ ছিল লোকটার। জগন্নাথ এবার দৃষ্টি আরও প্রখর ও অনুসন্ধিৎসু করে ভিক্ষুকটাকে দূর থেকে দেখতে লাগল।
তারপর একসময় জগন্নাথ ধীরে ধীরে গাঢাকা দিয়ে ওপাশের ফুটপাত দিয়ে পা চালিয়ে এগিয়ে গেল। এবং সোজা, এসে সে সুব্রতদের বাড়ির দরজায় কড়া ধরে নাড়া দিলঃ খট-খট-খটা-খট।
কে? সুব্রতর গলা শোনা গেল ভিতর থেকে।
আমি। দরজাটা খুলেন।
দাঁড়ান, খুলছি।
দরজাটা খুলতেই জগন্নাথ-বেশী কিরীটী রায় হাসতে হাসতে মাথায় বসানো রবারের পরচুলাটা খুলতে খুলতে বললে, মতে জগন্নাথ সাহু। কত্ত ঘুরি ঘুরি কটক জিলা কো মতে কলকাতার–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুব্রত হা হা করে হেসে বললে, উঃ, কি বিভীষণ লোক আপনি মশাই!
না মশাই, বিভীষণের মত আমি স্বজাতিদ্রোহী নই।
বিভীষণ স্বজাতিদ্রোহী? কি বলেন আপনি?
তা বৈকি। যে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মত্যুবাণ ও তার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জাতির স্বাধীনতা মানসম্ভ্রম অপরের হাতে তুলে দিতে পারে, তাকে শ্রীরামচন্দ্র যতই পূত আশীর্বাদ দিয়ে গরীয়ান করে তুলুন না কেন, তথাপি আমি বলব সে নীচ; সে কলঙ্ক—সে সমাজদ্রোহী-স্বজাতিদ্রোহী—বিশ্বাসঘাতক। উত্তেজনায় ও ভাবের দোলায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে এল; কিন্তু সে কথা থাক, তার চাইতেও বড় কাজ আমাদের সামনে। খোশগল্প করে আসর জমাবার মত অবকাশ আমাদের এখন এতটুকুও নেই।– বলতে বলতে ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী রায় গায়ের ছদ্মবেশগুলো খুলে ফেলতে লাগল।
ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়? কণ্ঠস্বরে সুব্রতর খানিকটা উদ্বেগ ও কৌতুহল প্রকাশ পায়।
তাড়াতাড়ি একটা চাদর আর একটা লাঠি আনতে পারেন?
কি হবে? কাউকে লাঠ্যৌষধির ব্যবস্থা করছেন নাকি?
রহস্যচ্ছলে জবাব দিল কিরীটীঃ
শৃণু শৃণু রে বর্বর!
দেরি যদি কর, বিপদ হবে বড়।
শীঘ্ৰ আন লাঠি ও চাদর।
সুব্রত হাসতে হাসতে লাঠি ও চাদর সংগ্রহ করতে উপরে চলে গেল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা বাঁশের লাঠি ও সাদা চাদর এনে কিরীটীর হাতে দিল।
এবারে পকেট থেকে একটা টিকিওয়ালা পরচুলা বের করে কিরীটী মাথায় বেশ করে বসিয়ে নিল, তারপর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লাঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল সোজা হয়ে, সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে। কার সাধ্যি এখন তাকে একটু আগের কিরীটী রায় বলে চিনতে পারে! এখন সে অতি নিরীহগোছের একটি পুজারী ব্রাহ্মণ।