আকাশে বোধ হয় মেঘ করেছে। মেঘের আড়ালে সর্য গেছে চেকে, তাই অবেলাতই নেমে এসেছে অন্ধকারের একটা ধসর ছায়া সর্বত্র। বাড়ির ভিতরটা হয়ে উঠেছে আরো অস্পষ্ট।
জগন্নাথ পা টিপে টিপে ওপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ির ধাপগুলো প্রশস্ত হলেও ভেঙ্গে ক্ষয়ে গিয়ে একেবারে ইট সব বের হয়ে পড়েছে। জগন্নাথ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। সামনেই একটা প্রশস্ত টানা বারান্দা। এখানটাও আবছা মেঘে ঢাকা আলোয় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেঘলা আকাশে বোধ হয় বিদ্যুৎ চমকে গেল, মুহর্তের জন্য আবছা অন্ধকারের বুকে একটা হঠাৎ আলোর ঢেউ তুলে। জনহীন এই বাড়িটার সর্বাঙ্গে যেন একটা পুরু ধুলার আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধুলোবালির কেমন একটা তীব্র কটু গন্ধ নাসারন্ধ্রকে পীড়িত করে তোলে।
দোতলায় বারান্দার জমাট ধুলোর ওপরে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বহু পদচিহ্ন। পদচিহ্নগুলো অল্পদিনের বলেই মনে হয়। বর্তমানে যে এই জনহীন পোড়ো বাড়িতে অনেকের নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয়েছে, সেটা বুঝতে কারুরই বিশেষ তেমন কষ্ট হবে না। জগন্নাথ তার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে—একটু আগে কাঠের ক্রাচের সাহায্যে যে লোকটা নীচে নেমে গেল, কে ও? কি জন্যই বা এখানে এসেছিল?
লোকটা নিম্নশ্রেণীর—তার বেশভূষা চালচলন থেকেই বোঝা যায়।
বাইরে বোধ হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামল। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে ঝাপটা দেয়।
সহসা একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ জগন্নাথের কানে এসে প্রবেশ করে।
অতি সতর্ক জগন্নাথের শ্রবণেন্দ্রিয় মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠে।
মৃদু গোঙানির শব্দ না? হ্যাঁ, ঐ তো অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!
বৃষ্টিটা কি এবারে জোরেই নামল ঐ সময়!
আবছা আলোছায়ার মধ্যে সেই গোঙানির শব্দটা যেন আরও সুস্পষ্ট হয়ে হানাবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝি অশরীরীর বুক-ভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাসের মতই মনে হয়। সহসা এমন সময় পাশ থেকেই ফিসফিস করে একটা অস্পষ্ট চাপা, কণ্ঠস্বর জগন্নাথের কানে এল। চট করে সিঁড়ির কপাটের আড়ালে সরে এল সে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল কে যেন বলছেঃ না, কর্তার হকুম। আগামী শনিবারের পরের শনিবারের মধ্যে যেমন করেই হোক ও তিন বেটাকেই ওখানে হাজির করাতে হবে। শির জামিন দিয়ে এসেছি।
আরে বাবা, এ তো তোমার মগের মুলক নয় যে যা খুশি তাই করবে। এদিকে এক বেটা ফেউ জুটেছে কিরীটী রায়। বাছাধন শুনি নাকি আবার শখের টিকটিকি।
কিরীটী রায়? লোকটা কিন্তু খুব সুবিধের নয় বলেই শুনেছি। তা সে কথা থাক। দেখ একটা সন্দেহ আমার মনে জাগছে, কর্তাও যেন এখানে এসেছেন। তবে এ আমার অনুমান মাত্র।
অনুমান কেন? সত্যিও তো হতে পারে।
অসম্ভব কিছুই নেই। উনি যে কোথায় কি ভাবে যান তো বোঝাই দায়। উঃ, সেবার পাশাপাশি এক হোটেলে সারারাত কাটিয়েও টের পাইনি যে কর্তা আমার পাশেই আছেন। নিজেই যখন ধরা দিলেন, চমকে উঠলাম। সে কথা যাক, পরশুর জাহাজেই তো যাওয়া ঠিক?
এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক আছে, তবে শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, কে বলতে পারে বল?
এমন সময় আবার সেই করুণ গোঙানির শব্দটা শোনা গেল।
প্রথম ব্যক্তি বললে, নাঃ, বেটা জালালে দেখছি! আর ছাই বর্মা-মুলুকেই বা টেনে নিয়ে লাভ কি? এখানে শেষ করে দিলেই তো হয়, যত সব ঝামেলা! কণ্ঠে বেশ বিরক্তির ঝাঁজ।
জানিস তো, কর্তা খুনোখুনির ব্যাপারটা তেমন পছন্দ করেন না! জানিস তো!
কিন্তু পরে ঠেলা সামলাবে কে? আজ রাত্রি আটটায় আমাদের আড্ডায় যাবার কথা। সেখানে কাজের ফিরিস্তি সব ঠিক হবে। এখন চল, সেদিকেই যাওয়া যাক।
প্রথম ব্যক্তি জবাবে বললে, তুই এগিয়ে যা। সেই চীনাপট্টির-নং বাড়িটাতেই তো? আমি একটু পরে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
কথা শেষ হতেই লোকটা এগিয়ে আসে। জগন্নাথ যেখানে দাঁড়িয়েছিল লোকটা সেদিকেই আসছে দেখে জগন্নাথ একেবারে দেয়াল ঘেষে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াল। পোড়ো বাড়িতে সাঁঝের আঁধারটা যেন থরে থরে চাপ বেধে উঠেছে তখন চারিদিকে।
বহুদিনকার বদ্ধ আবহাওয়ার বিশ্রী একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। জগন্নাথের যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
জনহীন হানাবাড়ির কঠিন মৌনতা যেন সেই সন্ধ্যার আঁধারে এক অশরীরী বিভীষিকার মায়াজাল রচনা করেছে চারিদিকে। কাদের অশ্রুত চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যেন আঁধারের গায়ে গায়ে বেধে উঠেছে। বাতাস নেই। এমন কি চতুঃসীমায় নেই একবিন্দু আলো। অভিশপ্ত পুরী…
লোকটা যে শেষ পঈযন্ত কোন পথে গেল জগন্নাথ বুঝতে পারলে না। আরও কিছুক্ষণ পরে জগন্নাথ যেদিক হতে কথার আওয়াজ আসছিল, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে সেইদিকেই এগিয়ে চলল। খানিক দূর এগোতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের ভেজানো কপাটের ফাঁক দিয়ে একটুখানি অস্ফুট আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সন্তর্পণে জগন্নাথ এগিয়ে গিয়ে কপাটের ফাঁকে চোখ দিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশে কেউ নেই। কপাটের ফাঁক দিয়ে জগন্নাথ দেখতে পেল ছোট একখানি ঘর। ভিতরে একটা মোমবাতির সামনে কে একটা লোক যেন ঝুকে পড়ে মোমবাতির আলোয় কি একটা পড়ছে।
লোকটার চোখ-মুখের রেখায় রেখায় গভীর একাগ্রতা ফুটে উঠেছে।
জগন্নাথ ধীরে অতি ধীরে ডান হাতের একটা আঙুল দরজার ভেজানো। কপাটের গায়ে ছোঁয়ালে, তারপর ঈষং একটু চাপ দিতেই আপনিই কপাটটা একটু সরে গেল। কিন্তু লোকটার সেদিকে খেয়াল নেই; সে আপন মনে কাগজটার ওপর ঝুকে পড়ে সেটা পড়ছে তখন।