সুব্রত বললে, বনমালী বসু তো?
না, কালো ভ্রমর স্বয়ং।
হ্যাঁ, আমিও তাই বলছি, বনমালী বসুই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
না, বনমালী বসু কালো ভ্রমর নয়।
সে নয়! তবে?
আপনাদের পোড়ো বাড়ির সামনে শিকারী বিড়ালই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
কি করে এ কথা আপনি বুঝলেন?
পরে বলব, তবে বনমালী বসুও কালো ভ্রমরের দলের লোকই বটে এবং সে বিষয়েও কোন ভুল নেই। এতে করে এও প্রমাণিত হচ্ছে যে তারা আটঘাট বেধেই কাজে নেমেছে এবারে। অবশ্য বনমালী বসুর কথাবার্তাতেই আপনাদের বোঝা উচিত ছিল, অনেক কিছু অসঙ্গতি তাঁর কথার মধ্যে আছে, ভদ্রলোক ডিব্রুগড়ে বসেই সি, আই, ডি-র তার পেয়েছিলেন মাত্র দিন দশেক আগে, কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে ডিব্রুগড়ে বসে তার পেলেও, ঐদিনকার রেঙ্গুনের সংবাদপত্রের কাটিংটা পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে! সন্দেহ তো ঐখানেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
আশ্চর্য, এটা কিন্তু আমাদের আপদেই মনে হয়নি! বলে সুব্রত।
না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এরপর সুব্রত ও রাজু, কিরীটীর নিকট বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে নামল।
০৫. ১৮ নম্বরের হানাবাড়ি
দ্বিপ্রহরের প্রখর রৌদ্রে সমস্ত শহরটা ঝাঁঝাঁ করছে। প্রচণ্ড তাপে রাস্তার পিচ নরম হয়ে উঠেছে। একটা অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভূত হয়। ট্রাম-বাসগুলো খড়খড়ি এটে যে যার গন্তব্যপথে ছুটছে। রিক্সাগুলো ঠং ঠং আওয়াজ করে দ্বিপ্রহরের রৌদ্রদগ্ধ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।
সুব্রত দরজা-জানালা এটে মেঝেয় একটা মাদুর পেতে তার উপর রেঙ্গুনের একটা ম্যাপ প্রসারিত করে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল, এমন সময় বাইরে কড়ানাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। রাজু পাশেই শুয়ে দিব্যি নাক ডাকছে। এত গ্রীষ্মেও তার ঘুমের কোন ব্যাঘাত হচ্ছে না।
সুব্রত চোখ ফিরিয়ে নিদ্রাভিভূত রাজুর দিকে একবার চাইল, তারপর উঠে দরজা খুলবার জন্য ঘর হতে বেরল।
তখনও সদর দুয়ারে কড়ানাড়ার শব্দ হচ্ছে খট-খট-খট। দরজা খুলতেই ও দেখলে সামনে দাঁড়িয়ে একজন এদেশীয় উৎকলবাসী।
কি চাই? সুব্রত লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
দণ্ডবৎ। রাজেনবানুর গলি কৌটি পড়িব বাবু? মতে নতুন কটক হইতে আইছন্তি। কলকাতার শহর এমতি সে মু কিমিতি জানিব? অঃ, গোট্টা শহর কত্ত ঘুরিল; ঘুরিতে ঘুরিতে এক বাবু বলি দিলা, গুটে রাজেনবাবুর গলি এক রাস্তা অছি বটে; আমহার স্ট্রীটের ধারে।
সুব্রত একদৃষ্টে শ্রীমান উৎকলবাসীর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। লোকটা লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। চোখ দুটো উজ্জল-ঝকঝক করছে অসাধারণ বুদ্ধির দীপ্তিতে, ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট চল। জুলপিটাকে খুর দিয়ে কামিয়ে একেবারে রগ পর্যন্ত তোলা হয়েছে। একটা গোলাপী রংয়ের জাপানী সিল্কের জামা গায়ে, বহুদিনের ব্যবহারে তেলচিটচিটে হয়ে কেমনতর যেন হয়ে উঠেছে। পরনে একটা নতুন চওড়া লালপাড় কোরা ধুতি। গলায় একটা পাকানো চাদর গিট দেওয়া, কতকালের ময়লা যে তার ভাঁজে জমে উঠেছে, সঠিক নির্ণয় করাটা একান্তই দুষ্কর। মুখে একগাল পান; দুই কষের কোলে পানের রস ও সুপারির গুড়া আটকে রয়েছে। বগলে পুরাতন একখানি ছাতা ও বাঁ-হাতে বটুয়া।
তোর নাম কি? সুব্রত শুধাল।
শ্রীল শ্রী শ্রীমান জগরনাথ।
এই বাঁ-ধারের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলেই ডান দিকে যে সরু গলি সেটাই রাজেনবাবুর গলি।
দণ্ডবৎ! বলে জগন্নাথ চলে গেল।
সুব্রত লক্ষ্য করলে লোকটা একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। লোকটাকে যতক্ষণ দেখা যায় সুব্রত বেশ ভাল করেই দেখল। তারপর যখন সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ওপারে চলে গেল।
মনে মনে কিন্তু জগন্নাথের কথাই ভাবছিল।
***
গত রাত্রের সরু গলিপথ ধরে সুব্রতর নির্দেশমত অবশেষে জগন্নাথ ১৮নং বাড়ির পিছন দিককার ভাঙা দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল। এইটাই সেই পোড়ো বাড়ি। দু-একবার শ্যেন দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে আস্তেআস্তে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল চট করে।
আগেই বলেছি বাড়িটা বহুদিনকার। দেওয়ালে দেওয়ালে চুনবালি ঝরার সমারোহ। ইটগুলো দেওয়ালের গায়ে গায়ে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে পড়েছে। জানালার কপাটগুলো খিলানের গায়ে কোথাও অর্ধভগ্ন, কোথাও বা জর্জরিত হয়ে ঝুলছে—মাঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় এদিক-ওদিক নড়ে ওঠে। জগন্নাথ সামনের একটা দরদালান পার হয়ে একতলার উঠোনের সামনে এসে দাঁড়াল।
উঠোনের সিমেন্ট চটে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে, তার মাঝে মাঝে শ্যাওলা জাতীয় আগাছাগুলো গজিয়ে উঠেছে। উঠোনের ওধারে একই ধরনের গোটা পাঁচ-ছয় ঘর সারিবদ্ধ ভাবে আছে। কোনটির কপাট বন্ধ, কোনটির কপাট হা-হা করছে—একেবারেই খোলা। জগন্নাথ এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বারান্দায় দক্ষিণের কোণ ঘেষে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। সহসা দোতলার বারান্দায় কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দটা ক্রমে জোরে শোনা যাচ্ছে।
কে যেন দম দম করে সিঁড়িপথেই নেমে আসছে।
জগন্নাথ চট করে সিঁড়ির পাশের একটা বড় থামের পেছনে সরে দাঁড়াল। কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছে, তারই শব্দ। জগন্নাথ কান পেতে রইল। থামের আড়ালে থেকে সে দেখলে, আধবয়সী একজন বেটেমত লোক নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। লোকটার গায়ে একটা সাধারণ বার্মিজ কোট। মাথায় একটা ফেজ। লোকটির একটা পা কাঠের। বগলে তার একটা কাঠের ক্রাচ। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কাঠের পায়ে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল এবং ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।