সুবিমলবাবু চুপ করলেন।
সুব্রত সুবিমলবাবুর কথা শুনতে শুনতে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। একটা অন্ধকার রহস্যের যবনিকা যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। একটা সন্দেহ মনের কোণে জট-পাকানো ছিল—তবে কি বাবলুই সেই হারানো মেয়ে? তাই যদি হবে, তবে বাবলুর সঙ্গে মিঃ সরকারের খুনের সম্পর্ক কী?
হঠাৎ একটা আলোর রেখা যেন অন্ধকারের বুকখানাকে ঝলসে দিয়ে গেল—পেয়েছি,
পেয়েছি!
এমন সময় সুবিমলবাবু আবার প্রশ্ন করলেন, কী ভাবছেন সুব্রতবাবু?
ভাবছি আপনার কথা যদি সত্যিই হয়, তবে কে চিঠিটা লিখল আমাকে?
তা যদি জানতাম, তবে সেকথা সেদিনই আপনাকে আমি বলতাম সুব্রতবাবু!
সুব্রত যখন সুবিমলবাবুরর কাছে থেকে বিদায় নিল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। অফিসের সর্বে ছুটি হতে শুরু করেছে।
১৯. সুবিমলবাবুর ওখান থেকে অফিসে ফিরে
সুবিমলবাবুর ওখান থেকে অফিসে ফিরে আসতেই কতকগুলো কাজে সুব্রত দিন দুই এমনভাবে আটকা পড়ে গেল যে কোনদিকে আর সে নজর দেবারও ফুরসত পেল না।
ইতিমধ্যে একবার সে কিরীটীকে ফোন করেছিল। শুনলে কিরীটী কলকাতার বাইরে কোথায় গেছে দুদিনের জন্য। অমিয়াদিকে বলাই ছিল, অন্ততপক্ষে সকালে ও রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে দুবার সুব্রতকে ফোন করে নিয়মিতভাবে বাবলুর সংবাদ দেওয়ার জন্য। কেননা সুব্রতর একপ্রকার স্থির বিশ্বাসই ছিল, বিপক্ষ দল সহজে সুব্রতকে নিষ্কৃতি দেবে না। তাছাড়া মিঃ সরকারের খুনের ব্যাপারের সঙ্গে বাবলুর জীবন-রহস্যের যোগাযোগ সত্যিই যদি তার সন্দেহমত থেকে থাকে, তবে তারা বাবলুকে সরাবার চেষ্টা করবেই।
এই সব নানা কারণে সুব্রত ইন্টেলিজেন্স বিভাগের দুজন তরুণ যুবক শিশির ও সমরকে বাবলুর প্রহরায় নিযুক্ত করেছিল।
শিশির ও সমর দুজনে পর্যায়ক্রমে দিবারাত্র এক একসময় এক একজন অমিয়াদির বাড়ির পাশে পাহারা দিত।
বাবলু এ বাড়িতে আসার তৃতীয় দিন বিকালের দিকে হঠাৎ একসময় রাণু এসে বাবলুর সামনে দাঁড়াল। বাবলু দোতলার রাস্তার উপরে ঝুলন্ত বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নীচের পার্কের ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি খেলাধূলা দেখছিল।
রাণু মৃদুস্বরে এসে বললে, বাবলু, তুমি আমার ওপরে সেদিনের ব্যবহারে নিশ্চয়ই রাগ করেছ, না?
হঠাৎ রাণুকে এত কাছাকাছি দেখে বাবলু বেশ যেন একটু থতমতই খেয়ে গিয়েছিল। সে অবাক হয়ে ভীত কাতর দৃষ্টি মেলে রাণুর মুখের দিকে তাকাল।
আমার উপরে রাগ কোরো না বাবলু। চল আমরা পার্কে বেড়িয়ে আসি। যাবে?
তার ভয়ে কোনমতে সেঁক গিলে বাবলু বললে, যাব।
রাণুর পিছনে পিছনে বাবলু পার্কে বেড়াতে গেল। পার্কে খানিকটা ঘুরে এদিক ওদিক বেড়াবার পর রাণু এক সময় বাবলুকে বললে, খুব বেশি লোকজন এখন পার্কে, তাই এত গোলমাল। খাওয়াদাওয়ার পর রাত্রে অনেক দিন আমি লুকিয়ে পার্কে বেড়াতে এসেছি। রাত্রে ঐ মোড়ে রামদিনের কুলপি মালাই পাওয়া যায়। খুব সুন্দর খেতে। আজ রাত্রে এসে খাওয়া যাবেখন, কেমন?
বাবলু বললে, কিন্তু রাত্রে বাড়ি থেকে বের হলে মা যদি বকেন!
দূর, মা জানতে পারবে কেমন করে? লুকিয়ে আসব না! বাবলু চুপ করে রইলো। কোন জবাব দিল না।
রাণুর বাবা ডাঃ বোস সাধারণত একটু বেশী রাত্রি করেই বাড়ি ফেরেন। কাজে কাজেই অমিয়াদির, সমস্ত কাজ করে শুতে যেতে রাত্রি সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।
খাওয়াদাওয়ার পর রাত্রি নটার সময় রাণু এসে বাবলুকে বিছানা থেকে ডেকে তুলল। বাবলু আলাদা ঘরে একাই শুতে। রাণুর পাশের ঘরে। ঘুম ভেঙে বাবলু রাণুর মুখের দিকে তাকাল। বারান্দার ঢাকনি দেওয়া ইলেকট্রিক বাতির রশ্মিটা রাণুর মুখের উপরে এসে পড়েছে। চোখ দুটো যেন তার কী এক উত্তেজনায় চক্ করছে। ও সভয়ে চোখ বুজে ফেলল।
রাণু অধীর হয়ে বাবলুকে আবার ধাক্কা দিল, কই চল, যাবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে!
বাবলু উঠে বসল।
দুজনে পা টিপে টিপে এসে সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল।
চাপা গলায় বাবলু বললে, আমার বড্ড ভয় করছে রাণুদি। মা যদি বকেন!
চল, চল বোকা মেয়ে! মা জানতে পারবে কী করে? আমরা তো একটুক্ষণ পরেই এসে আবার শুয়ে থাকবো। কেউ টের পাবে না।
আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে।
আয়, দেরি করিস নে। ফিরতে আবার দেরি হয়ে যাবে।
দুজনে এসে রাস্তার ওপারে দাঁড়াল।
অন্ধকার রাত্রি। তার উপর আবার ব্ল্যাক-আউটের মহড়া। ঘেরাটোপে ঢাকা গ্যাসের ম্লান আলো রাস্তার ওপর একটা যেন স্তিমিত আলোছায়ার সৃষ্টি করেছে।
বাড়ির সামনেকার অপ্রশস্ত জনহীন রাস্তাটা পার হয়ে রাণুর পিছু পিছু বাবলু এসে দেশবন্ধু পার্কের মধ্যে প্রবেশ করল।
পার্কটাও জনহীন। কেউ কোথাও নেই।
ময়দানের মাঝখান দিয়ে লাল সুরকির অপ্রশস্ত রাস্তা ধরে দুজনে এগিয়ে চলে।
অদূরে একটা বেঞ্চির ওপরে বসে কে যেন গান গাইছে।
ও আমার নীলমণি!
তোর জ্বালায় আর পারিনে নীলমণি!
ও আমার কেলে সোনা,
তুমি পাড়ায় যেও না;
পাড়ায় গেলে ধুলো দেবে
গায়ে সবে না।।
কে গাইছে রাণুদি? বাবলু চলতে চলতে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল।
ও বিশু পাগলা। এই পাড়াতেই থাকে। চল, আবার থামলে কেন? ওই গেটের মুখে কুলপী বরফওয়ালা থাকে। তাড়াতাড়ি চল। দুজনে এসে যখন ওদিককার গেটের সামনে দাঁড়াল, জায়গাটা খালি-খালি, জনমনিষ্যিও সেখানে নেই।
কই তোমার বরফওয়ালা, রাণুদি?
এখানে আজ নেই দেখছি। বোধ হয় ওই রাস্তার মাথায় বসেছে, চল দেখি!