- বইয়ের নামঃ নীরক্ত করবী
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ধের সমাজে একা
রাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়ক। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
যে-কোনো মুহূর্তে ঘোর মারামারি হতে পারে, তবু
অস্ত্রগুলি উল্টানো রয়েছে আপাতত।
পরস্পরের দিকে পিঠ দিয়ে সকলে এখন
সম্মান রচনা করে। আমি দেখি,
অযুত নিযুত অন্ধ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপরে।
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই।
আমি সেনাপতি। আমি সৈন্য-পরিদর্শনে এসেছি।
কিন্তু তার সেনাপতি, কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না।
আমি শুধু দেখতে পাই, দশ লক্ষ যোদ্ধার সভায়
কাহারও কপালে অক্ষিতারকার শোভা নেই;
কপালে গভীর দুই গর্ত নিয়ে সবাই দাম্ভিক দাঁড়িয়েছে।
আমি একা দেখতে পাই, আমি একা দেখতে পাই, আমি
দশ লক্ষ যুযুধান অন্ধের সভায় আজ একা।
অথচ অন্ধের দেশে একা চক্ষুষ্মান হওয়া খুব ভয়াবহ।
প্রধান সড়কে তাই সৈন্য-পরিদর্শনের কালে
বারবার চমকে উঠি। মনে হয়,
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার অধিক
বিড়ম্বনা কিছু নেই, কখনও ছিল না।
রাস্তার দুই ধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে যুদ্ধে সমুৎসুক
অন্ধ সেনাদল।
আমি হেঁটে যাই। আমি হেঁটে যেতে-যেতে
গুরুবন্ধনার ছলে দেখে যাই, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরে হতেছে সেঁকা, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
আপাতত রণাঙ্গন নিস্তব্ধ যদিও,
আমি তবু বুঝতে পারি, নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আগুনে
সর্বত্র ভীষণ ধুমধাড়াক্কার উদ্যোগ চলেছে।
আমি সেনাপতি। আমি প্রধান সড়ড়ে হেঁটে যাই।
অথচ কখন যুদ্ধ শুরু হবে, কার যুদ্ধ, কিছুই জানি না।
কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না!
(আমি কার সেনাপতি, আমি কার সেনাপতি) আমি
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার বিপদ
টের পেতে-পেতে আজ গুরুবন্দনার ছলে ভাবি,
এবার পালানো ভাল দৌড়িয়ে। নতুবা
যদি ভীমরবে সেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়, তবে–
যেহেতু নিদানকালে চক্ষুলজ্জা ভয়াবহ, তাই–
নিজের চক্ষুকে হয়তো নিজেরই নখরাঘাতে উপড়ে ফেলে দিয়ে
অন্ধের সমাজে আজ মিশে যেতে হবে।
উপাসনার সায়াহ্নে
ভীষণ প্রাসাদ জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
অলিন্দ, ঝরোকা, শ্বেতমর্মরের সমস্ত নির্মাণ
জ্বলে ওঠে। আগুনের সুন্দর খেলায়
দাউদাউ জ্বলে হর্ম্য, প্রমোদ-নিকুঞ্জ। কিংবা সাধের তরণী
অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন অন্যপথে ধীরে আগুয়ান
হতে গিয়ে অগ্নিবয়লয়ের দিকে ঘুরে যায়।
মুহূর্তে মাস্তুলে, পালে, পাটাতনে প্রচণ্ড হলুদ
জ্বলে ওঠে।
সাধের তরণী জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
জানি না কখনও কেউ এমন জ্বলেছে কি না সায়াহ্নবেলায়।
যেমন প্রাসাদ জ্বলে, অলিন্দ, ঝরোকা কিংবা শ্বেতমর্মরের
বিবিধ নির্মাণ। যথা সহসা দাউদাউ
প্রমোদ-নিকুঞ্জ, ঝাউ-বীথিকা, হ্রদের জল, জলের উপরে
সাধের তরণীখানি জ্বলে ওঠে।
যেমন কুটির কিংবা অট্টালিকা কিছুকাল চিত্রের মতন স্থির থেকে তারপর
অগ্নিবলয়ের দিকে চলে যায়।
যেমন পর্বত পশু সহসা সুন্দর হয় বাহিরে ও ঘরে।
যেমন সমস্ত-কিছু জ্বলে, চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
একটাই মোমবাতি
একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ?
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো,
হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও,
হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও,
অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন
কিছুই হয়নি, যেন
যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না।
অন্য কিছু না থাক, তোমার
স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে
ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি
নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর
অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না;
এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্রাউজের হলুদে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।
জলে নামবার আগে
সকলে মিলিত হয়ে যেতে চাই আজ
পৃথিবীর মিশকালো ঘরে।
গিয়ে স্থিত হতে চাই, কাঠের জাহাজ
যেমন সুস্থির হয় জলের জঠরে।
কেননা আলোয় যারা করে চলাচল,
ডাঙায় তাদের কাছে বিশ বাঁও জল।
যেন সব ভুলে যাই, কোন্খান থেকে
কত দূরে কোথায় এলাম।
আলোকিত দেবতার মুখ যায় বেঁকে,
প্রেমিক জানে না তার প্রেমিকার নাম।
জীবনে কোথাও ছিল এত বড় দহ,
জানত না মানুষের বাপ-পিতামহ।
অথচ আকাশ নীল। ফুলের প্রণয়
হাওয়ায় সলিলে ওই ভাসে।
ছোঁবার সাহস নেই, যেন খুব ভয়
শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে।
যদিও সবাই জানে, খুঁজতে গেলেই
দেখা যাবে, কারও আজ শিরদাঁড়া নেই।
ফলত সবাই যেন যেতে চাই আজ
পৃথিবীর মিশকালো ঘরে।
সবাই লুকোতে চাই; কাঁকড়া কি মাছ
যেমন লুকিয়ে থাকে জলের জঠরে।
এদিকে ডাঙায় যারা করে চলাচল,
ডাঙাই তাদের কাছে বিশ বাঁও জল।
জিম করবেটের চব্বিশ ঘণ্টা
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
যত দূরে যেখানে যাই,
পাহাড় ভাঙি, তাঁবু ওঠাই–
ছায়া পড়ে।
দৃশ্য অনেক, নেবার পাত্র
পৃথিবীতে একটা মাত্র–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
এই যে বসি, এই যে উঠি,
থেকে-থেকে বাইরে ছুটি–
ছায় পড়ে।
পিছন-পিছন ঘুরেছি যার,
সেই নিয়েছে পিছু আমার–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
সকল কাজে, সকল কথায়,
জলেস্থলে তরুলতায়–
ছায়া পড়ে।
এখন আমি বুঝব কিসে
শিকার কিংবা শিকারি সে–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।
জীবনে একবারমাত্র
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন বুকের ভিতরে
ভীষণ শোরগোল ওঠে। শুনতে পাই
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন
তটভূমি ধসে পড়ছে, ছলোচ্ছল ছলোচ্ছল
ঢেউ লাগছে নিরুপায় নৌকায়। রক্তের
পাতালবাহিনী নদী হঠাৎ ভীষণভাবে
ফুলে ফেঁপে ওঠে।–আমি বালকবয়সে
ট্রেনের কামরায় কোনো বৃদ্ধ ফিরিঅলাকে একবার
আশ্চর্য মলম হাতে দারুণ বাঘের মতো চেঁচাতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–আমি
ঘাটশিলার হাটে এক লালাকে একবার
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’ বলে অসম্ভব পুরনো পেঁয়াজ
বিক্রি করে হাসতে দেখেছি!–আমি
মফস্বল-শহরে একবার
ঘণ্টা-হাতে সার্কাসের তাঁবুর বাইরে কাকে গম্ভীর গলায়
অন্ধকারে বলতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–আমি গঙ্গার জেটিতে
সন্ধ্যায় লঞ্চের দড়ি তুলে নিতে-নিতে এক প্রাবীণ মাল্লাকে যেন জীবনে একবার
ভয়ঙ্কর আত্মমগ্ন বলতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–কিন্তু বুকের ভিতরে
এই যে প্রলয়রোল শুনতে পাওয়া গেল–কোনো বৃদ্ধ ক্যানভাসার,
ধূর্ত লালা, সার্কাসের দালাল অথবা
মাল্লার গলার সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না।
জীবনে একবারমাত্র। রক্তের ভিতরে
জীবনে একবারমাত্র ‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’ এই বন্য মহারোল
শুনতে পাওয়া যায়, আমি শুনতে পাচ্ছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন
নিরুপায় নৌকার শরীরে
ছলোচ্ছল ছলোচ্ছল ঢেউ লাগছে। যেন
রক্তের পাতালগঙ্গা, দাঁড়ি-মাঝি-বৈঠা-হাল ইত্যাদি সমেত,
ভীষণ পাক খেতে-খেতে, ভীষণ পাক খেতে-খেতে
জলস্তম্ভ হয়ে গিয়ে ফুলে-ফেঁপে হঠাৎ স্বর্গের দিকে
দৌড়ে উঠে যায়।
তর্জনী
তর্জনী দেখিয়ে কেন কথা বলো…কখনও বলবে না…
কাকে…তুমি ভয় দেখাও কাকে…
আমি অনায়াসে সব ভেঙে ফেলতে পারি…
মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারি সবকিছু…
বাঁ পায়ের নির্দয় আঘাতে আমি সব
মুছে ফেলতে পারি…
তর্জনী দেখিয়ে কেন কথা বলো…কখনও বলবে না…
ভীষণ চমকিয়ে দিয়ে দশটার এক্সপ্রস চলে গেল।
পরক্ষণে পৃথিবী নীরব।
তারের উপরে বাজে হাওয়ার শাণিত ভাষা, আর
মিলায় চাকার শব্দ…তর্জনী দেখিয়ে কেন…
তর্জনী দেখিয়ে কেন…
যেন-বা হুড়মুড় শব্দে স্বপনের বাড়িটা
ভেঙে পড়তে গিয়ে টাল সামলে নিয়ে এখন আবার
অতল নয়নজলে জেগে রয়।
তোমাকে নয়ু
যেন কাউকে কটুবাক্য বলবার ভীষণ
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাক নয়।
যেন যত দুঃখ আমি পেয়েছি, এবারে
চতুর্গুণ করে তাকে ফিরিয়ে দেবার
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়।
দুই চক্ষু ভেসে গেল রক্তের ধারায়।
দমিত আক্রোশে খুঁড়ি নিজের পাতাল।
দ্যাখো আমি যন্ত্রণায় দাউ-দাউ আগুনে
জ্বলে যাচ্ছি, নেমে যাচ্ছি হিংসার নরকে।
যেন আত্মনিগ্রহের নরকে না-গিয়ে
সমস্ত যন্ত্রণা আজ ফিরিয়ে দেবার
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়…
নরকবাসের পর
১.
তোমরা পুরানো বন্ধু। তোমরা আগের মতো আছ।
আগের মতোই স্থির শান্ত স্বাভাবিক।
দেখে ভাল লাগে।
প্রাচীন প্রথার প্রতি আনুগত্যবশত তোমরা
এখনও প্রত্যহ দেখা দাও,
কুশল জিজ্ঞারা করো আজও।
দেখে ভাল লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ।
তোমরা পুরনো বন্ধু। অমিতাভ স্নেহাংশু অমল।
তোমরা এখনও
সুস্থির দাঁড়িয়ে আছ আপনি জমিতে।
সাঁইত্রিশ বছর তোমরা আপন জমিতে
দাঁড়িয়ে রয়েছ সুস্থ মাননীয় বৃক্ষের মতন।
দেখে ভাল লাগে।
আমি নিজে সুস্থ নই, সূর্যালোকে সুন্দর অথবা।
২.
আমি নিজে সুস্থ নই, আলোকিত সুন্দর অথবা।
আমি এক সুদূর বিদেশে,
অতি দূর অনাত্মীয় আঁধার বিদেশে
বৃথাই ঘুরেছি
দীর্ঘ দশ বছর, অমল।
অমল, তুমি তো রৌদ্র হতে চেয়েছিলে;
স্নেহাংশু, তোমার লক্ষ্য আকাশের অব্যয় নীলিমা;
তুমি অমিতাভ, তুমি জলের তরঙ্গ ভালবাসো।
আমি দীর্ঘ এক যুগ রোদ্দুরের ভিতরে যাইনি।
আকাশ দেখিনি।
সমুদ্র দেখিনি।
কী করে আকাশ তার মুখ দেখে সমুদ্রে–দেখিনি।
আমি এক আঁধার বিদেশে
চোখের সমস্ত আলো, বুকের সাহস,
দেহের সমস্ত স্বাস্থ্য তিলে-তিলে বিসর্জন দিয়ে,
দিনকে রাত্রির থেকে পৃথক জা-জেনে
দিন কাটিয়েছে।
৩.
আঁধার বিদেশ থেকে কখনও ফেরে না কেউ। আমি
আবার ফিরেছি।
ফ্যাকাশে চামড়া, চোখে মৃত মানুষের দৃষ্টি নিয়ে
ফিরেছি আবার আমি অমিতাভ, স্নেহাংশু, অমল।
এবং দেখেছি তোমাদের।
তোমার পুরানো বন্ধু। তোমরা আগের মতো আছ।
দেখে ভাল লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ।
দেখে ভাল লাগে।
আমিও আবার স্থির সুস্থ স্বাভাবিক হতে চাই।
আতি আমি ফিরেছি আবার
অমিতাভ, স্লেহাংশু, অমল।
তাই তোমাদের কাছে আবার এসেছি।
তিনটি জীবন্ত চেনা মানুষের কাছে
এসে দাঁড়িয়েছি।
উপরে আকাশ, নীচে অনন্ত সুন্দর জলরাশি,
পিছনে পাহাড়,
শোণিতে দৃশ্যের আলো জ্বলে।
আমি এইখানে এই বান-ডাকা রৌদ্রের বিভায়
অবিকল মাননীয় বৃক্ষের মতন
দু’ দণ্ড দাঁড়াব।
স্বাস্থ্য ফিরাবার জন্য এখন খানিক পথ্য প্রয়োজন হবে।
আমি এইখানে এই সমুদ্রবেলায়
অফুরন্ত নীলিমার নীচে
প্রত্যহ এখন যদি একগ্লাস টাট্কা রোদ খেয়ে যেতে পারি,
তবে আমি সুস্থ হয়ে যাব।
নিদ্রিত, স্বদেশে
পেটে-আসছে-মুখে-আসছে না, সেই কথাটা, সেই
হঠাৎ-শুনতে-পাওয়া কথাটা আমি
ভুলে গিয়েছি।
যে-কথা অস্ফুট স্বরে তুমি একদিন
যে-কথা অর্ধেক রাত্রে তুমি একদিন
সে-কথা স্বপ্নের মধ্যে তুমি একদিন বলেছিলে।
স্বপ্নের মধ্যে কেউ যখন কথা বলে,
তখন তাকে খুব অচেনা মানুষ বলে মনে হয়।
তখন তার নিদ্রিত মুখের দিকে তাকালে আমার মনে হয়,
অনেক বড়-বড় সমুদ্র পেরিয়ে, তারপর
অনেক উঁচু-উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে, তারপর
সুদীর্ঘ প্রবাস-জীবনের শেষে সে তার স্বদেশে ফিরেছে।
একমাথা রুক্ষ চুল, পায়ে ধুলো,
ঘুমের মধ্যে সে তার স্বদেশে ফিরেছে।
ঘুমের মধ্যে সে তার আপন ভাষায় কথা বলছে।
প্রিয় গাভীটির গলকম্বলে হাত বুলোতে-বুলোতে
খুব গভীর স্বরে সে তার বাড়ির লোকজনদের জিজ্ঞেস করছে,
সে যখন বিদেশে ছিল, তখন তার
আঙুল-বাগানোর পরিচর্যা ঠিকমতো হত কি না, তখন তার
খেতের আগাছা ঠিকমতো নিড়িয়ে দেওয়া হত কি না, তখন তার
গ্রামে কোনও বড়-রকমের উৎসব হয়েছিল কি না।
ঘুমের মধ্যে কি এসব প্রশ্ন করেছিলে তুমি?
আমার মনে নেই।
পেটে-আসছে-মুখে-আসছে না, সেই কথাটা, সেই
হঠাৎ-শুনতে পাওয়া কথাটা আমি
ভুলে গিয়েছি।
যে-কথা অস্ফুট স্বরে তুমি একদিন
যে-কথা অর্ধেক রাত্রে তুমি একদিন
যে-কথা স্বপ্নের মধ্যে তুমি একদিন বলেছিলে।
নিয়ন-মণ্ডলে, অন্ধকারে
যে যার জিজ্ঞাসাগুলি এবারে গুছিয়ে নাও।
কেননা, আর সময় নেই।
বিকেল-পাঁচটায় আমরা নিয়ন-মণ্ডলে যাব।
সেখানে সেই পৌঢ় পালোয়ানের সঙ্গে আমাদের
খুব জরুরি একটা অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট আছে,
তিন বছর আগে যাঁর শেষ প্রেস-কনফারেন্সে
আমরা উপস্থিত ছিলাম। এবং
নরম ডাঁটা দিয়ে ইলিশমাছের পাতলা ঝোল খেতে তাঁর ভাল লাগে কি না
এই প্রশ্নের উত্তরে যিনি বলেছিলেন,
“দিবারাত্রি কবিতা লেখাই আমার হবি।”
ঢোলা-হাতা মলমলের কামিজ পরনে
নিয়ন-মণ্ডলে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমাদের দেখেই তিনি ভীষণভাবে ডানা ঝাপটাতে লাগলেন এবং
তৎক্ষণাৎ সেই মুরগির উপমা আমাদের মাথায় এল,
যে কিনা এক্ষুনি একটা ডিম পাড়তে ইচ্ছুক।
কিন্তু ডিম না-পেড়েই তিনি বললেন,
“আগে কি তোমরা একটা ওমলেট খেতে চাও?”
আমরা বললুম, “না।
তার চাইত আপনার উপলব্ধির কথাটাই বরং বলুন।”
শুনে তিনি হাস্য করলেন। এবং
বুকের ভিতরে তাঁর চতুর্দশ উজ্জ্বল বাতিটা
জ্বালিয়ে তিনি জানালেন,
“চিরকাল নিয়ন-মণ্ডলে
অনেক কঠিন কাণ্ড দেখা যায়। তবু
পাতলুনের দক্ষিণ পকেটে
বাঁ হাত ঢোকাবার চাইতে
কঠিন সার্কাস কিছু নেই।”
বাতিগুলি তখন দপদপ করে নিভে গেল।
দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,
আর্ত গলায় বললেন, “আমাকে একটা আয়না দাও,
এক্ষুনি আমি আমার মুখ দেখব।”
কিন্তু তাঁর পিসিমা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন যে,
অন্ধকারে কখনও নিজের মুখ দেখতে নেই।
তাই তিনি মুখ দেখলেন না;
তার বদলে একটি কবিতা প্রসব করলেন।
তার আরম্ভটা এই রকম :
‘অন্ধকারে কোথায় অশ্রুর
ধারা বহে যায়।
কে যেন নিজের মুখ চিরকাল দেখতে চেয়েছে
নিয়ন-মণ্ডলে, অন্ধকারে!’
নীরক্ত করবী
আমরা দেখি না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ একদিন
পূর্বাকাশে সেই শুদ্ধ উদ্ভাস দেখেছে,
যাকে দেখে মনে হতো, নিহত সিংহের পিঠে গর্বিত পা রেখে
স্বর্গের শিকারী দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখন সেই উদ্ভাস দেখি না।
এখন রোদ্দুর দেখে মনে হয়, রোদ্দুরের পেটে
এখন আঁধার রয়ে গেল।
যেহেতু উদরে অম্ল, রক্তে বমনের ইচ্ছা নিয়ে
তবুও সহাস্যে হাঁটে সুবেশ যুবক,
যেহেতু শয়তান তার শখ
মেটাবার জন্য পারে ঈশ্বরের মুখোশ ভাঙাতে,
অতএব অন্ধকার রাতে
মায়াবী রোদ্দুর দেখা অসম্ভব নয়।
রৌদ্রের বাগানে রক্তকরবীনিচয়
ফুটেছে, ফুটুক।
আমি রক্তকরবীর লজ্জাহীন প্রণয়ে যাব না।
এখন যাব না।
রৌদ্র যে মুখোশ নয়, ঈশ্বরের মুখ,
আগে তা সুস্থির জেনে নেব।
না-জেনে এখনই আমি বাহির-দুয়ারে দাঁড়াব না।
পুতুলের সন্ধ্যা
আবার সহজে তারা ফিরে আসে আষাঢ়-সন্ধ্যায়।
তারা ফিরে আসে। কাগজের
সানন্দ তরণী, সাদা মাটির বিড়াল–
মুখে মস্ত ইলিশের পেটি। ফিরে আসে
কাঠের জিরাফ, সিংহ, কাকাতুয়া, আহ্লাদী পুতুল;
উড়ন্ত কিন্নরী; খড়কুটা ও কাপড়ে
ফাঁপানো ভীষণ মোটা শাশুড়ি, তরুণী বধু, ফুল, লতাপাতা;
কুরুশ-কাঁটার পদ্ম। একদা ফিরতেই হবে
জেনে সকলেই তারা আষাঢ়-সন্ধ্যায়
সহজ খুশিতে ফেরে ‘মনে-রেখো’-ছবির শৈশবে।
সবাই সহজে ফেরে। সময়ের কাঁটা
ঘুরিয়ে আবার যেন শৈশব-দিবসে ফেরা বড়ই সহজ।
কাঠের আলমারি কিংবা কলি-না-ফেরানো
দেওয়ালের শূণ্য জমি আষাঢ়-দিবসে
আবার সহজে তাই ভরে ওঠে, উপ্সরা-কিন্নরী-
জিরাফ-শাশুড়ি-বউ-সিংহ-কাকাতুয়ার বিভায়।
যেন অনায়াসে কোনো প্রাচীন জনতা
সমস্ত আইন ফাঁকি দিয়ে
সন্ধ্যার চৌরঙ্গি রোড একে-একে নির্বিকার পার হয়ে যায়–
সহজ আনন্দে, হাতে হ্যারিকেন-লণ্ঠন ঝুলিয়ে।
প্রেমিকের ভূমি
চুলের ফিতায় ঝুল-কাঁটাতারে আরও একবার
শেষবার ঝাঁপ দিতে আজ
বড় সাধ হয়। আজ দুর্বল হাঁটুতে
আরও একবার, শেষবার,
নবীন প্রতিজ্ঞা, জোর অনুভব করে নিয়ে ধ্বংসের পাহাড়
বেয়ে টান উঠে যেতে ইচ্ছা হয়
মেঘলোক। মনে হয়, স্মৃতির পাতাল কিংবা অভ্রভেদী পাহাড়ের চূড়া
ব্যতীত কোথাও তার ভূমি নেই।
প্রেমিকের নেই। তাই অতল পাতালে
অথবা পাহাড়ে তার দৃষ্টি ধায়।
মনে হয়, অন্ধকারে কোটি জোনাকির শবদেহ
মাড়িয়ে আবার ঝুল-কাঁটাটারে চুলের ফিতায়…
ভীষণ লাফিয়ে পড়ি। অথবা হাঁটুতে
নবীন রক্তের জোর অনুভব করে নিয়ে যুগল পাহাড়
ভেঙে উঠে যাই মেঘলোকে।
আরও একবার যাই, আরও একবার, শেষবার।
বাঘ
আঁচড়িয়ে কামড়িয়ে ফেঁড়ে কাণ্ডটাকে ফুলন্ত গাছের
তখনও দাউ-দাউ জ্বলে রাগ।
চিত্রিত বিরাট বাঘ।
ফিরে যায় ঘাসের জঙ্গলে। থেকে-থেকে
শরীরে চমকায় জ্বালা। দূরের কাছের
ছবিগুলি স্থির পাংশু! ত্রিজগৎ নিশ্বাস হারায়
চলন্ত হলুদ-কালো চিত্রখানি দেখে।
বাঘ যায়। বনের আতঙ্ক হেঁটে যায়।
বাঘ যায়। অন্ধকার বনের নিয়তি।
চিত্রিত আগুনখানি যেন ধীরে-ধীরে
হেঁটে যায়। প্রকাণ্ড শরীরে
চমকায় হলুদ জ্বালা। বড় জ্বালা। শোণিতে শিরায়
যেন ঝড়-বিদ্যুতের গতি
সংবৃত রাখার জ্বালা বুঝে নিতে-নিতে
বাঘ যায়। বনের আতঙ্ক হেঁটে যায়।
আমরা নিশ্চিন্ত বসে বাঘ দেখি ডিস্নির ছবিতে।
বার্মিংহামের বুড়ো
“ফুলেও সুগন্ধ নেই। অন্ততঃ আমার
যৌবনবয়সে ছিল যতখানি, আজ তার অর্ধেক পাই না।
এখন আকাশ পাংশু, পায়ের তলায় ঘাস
অর্ধেক সবুজ, নদী নীল নয়। তা ছাড়া দেখুন,
স্ট্রবেরি বিস্বাদ, মাংস রবারের মতো শক্ত। ভীষণ সেয়ানা
গোরুগুলি। বালতি ভরে দুধ
দেয় বটে, কিন্তু খুব জোলো দুধ। নির্বোধ পশুও
দুগ্ধের ঘনতা আজ চুরি করে কী অবলীলায়।
এদিকে মদ্যও প্রায় জলবৎ। আগে
দু-তিনটে বিয়ার টেনে অক্লেশে মাতাল হওয়া যেত।
ইদানিং কম করেও পাঁচ বোতল লাগে।”
বার্মিংহামের সেই বুড়োটার লাগে। যে সেদিন
ফুল নদী ঘাস মেঘ আকাশ স্ট্রবেরি
মাংস দুধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভীষণ
অভিযোগ তুলেছিল। যার বিধ্বস্ত মুখের ভাঁজে তিলমাত্র করুণা ছিল না,
উদরে সক্রিয় ছিল পাঁচ বোতল ঘোলাটে বিয়ার।
বৃষ্টিতে নিজের মুখ
অরণ্য, আকাশ, পাখি, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
আকাশ, সমুদ্র, মাটি, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
সমুদ্র, অরণ্য, পাখি, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
যতই ঘোরাও, আমি কী নতুন দেখব জাদুকর?
যেন দূরদেশে কোন্ প্রভাতবেলায়
যেতে গিয়ে আবার ফিরেছি
আজন্ম নদীর ধারে, পরিচিত বৃষ্টির ভিতর।
যেন সব চেনা লাগে। ফুল, পাতা, কিউমুলাস মেঘের জানালা,
সটান সহজ বৃক্ষ, গ্রামের সুন্দরী, আর
নানাবিধ গম্বুজ মিনার।
যেন যত দৃশ্য দেখি আয়নার ভিতরে,
উদ্ভিদ, মানুষ, মেঘ, বিকেলবেলার নদী–
বৃষ্টির ভিতরে সব দেখা হয়, সব
নিজের মুখের মতো পরিচিত। আমি
এই পরিচিত দৃশ্য করবার দেখবে জাদুকর?
আয়নায় জলের স্রোত, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
উদ্ভিদ, মানুষ, মেঘ, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
হাতের আমলকীমালা, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
যতই ঘোরাই, আমি কী নতুন দেখব জাদুকর?
বৃষ্টির ভিতরে সব দেখি যেন, আমি
আজন্ম নদীর ধারে, প্রাচীন ছায়ায়
পাহাড়, গম্বুজ, মেঘ, গ্রামের বালিকা,
দেবালয়, নদীজলে বশংবদ দৃশ্যের গাগরি–
দেখে যাই, যেন সব বৃষ্টির ভিতরে দেখে যাই।
যখন প্রত্যকে আজ দ্বিতীয় স্বদেশে
চলেছে, তখনও দেখি আয়নার ভিতরে জলধারা
নেমেছে রক্তের মতো। যাবতীয় পুরানো দৃশ্যের
ললাটে রক্তের ধারা বহে যায়। আমি
পুরানো আয়নায় কাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
নিজের রক্তাক্ত মুখ কত আর দেখব জাদুকর?
বয়ঃসন্ধি
কে কোন্ ভূমিকা নেব, কে কার বান্ধব হব, এইবারে সব
জানা যাবে বেতার-বার্তায়।
পুরনো বন্ধু ও পুঁথি, ইজের-কামিজ-ধুতি-প্যাণ্টের করুণ কলরব
শেষ হয়ে যায়
এখন মরিচা-পড়া সমস্ত পুরনো তালাচাবির গরব
মৎস্যের আহার হতে চায়।
এখন আমরা এক ভিন্ন লোকালয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এখন আমরা যেন আর-এক-সময়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এখন আমরা যেন ভয়ে-ভয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
আমাদের বন্ধুগুলি ক্রমে যেন আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতার
বন্ধু হয়ে যায়।
ক্রমেই আঁটসাঁট হয় আমাদের পাতলুন-পাঞ্জাবি।
নামের অক্ষরগুলি মুছে দিয়ে আদি নির্মাতার
আমাদের পুঁথিপত্র ধীরে-ধীরে যেন সব তাৎপর্য হারায়।
এখন মরিচা-পড়া আমাদের তোরঙ্গের চাবি
শুয়ে আছে মৎস্যের পাড়ায়।
ভিতর-বাড়িতে রাত্রি
রাত্রি হলে একা-একা পৃথিবীর ভিতর-বাড়িতে
যেতে হয়।
সারাদিন দলবদ্ধ, এখানে-ওখানে ঘুরি-ফিরি,
বাজারে বাণিজ্যে যাই;
মাঝে-মাঝে রোমাঞ্চিত হবার তাগিদে
সামান্য ঝুঁকিতে বসি তাসের আড্ডায়;
কেউ বা তিন-আনা যেতে; কেউ হারে।
রাত করলে সবাই উঠে যায়।
মাথায় কান-ঢাকা, টুপি, পায়ে, মোজা, বারোটা-রাত্তিরে
জানি না কোথায় যায় দুরি তিরি রাজা ও রমণী।
আমি যাব ভিতর-বাড়িতে।
ভিতর-বাড়ির রাস্তা এখনও রহস্যময় যেন।
এত যে বয়স হল, তবুও অচেনা লাগে।
কোথায় কবাট-জানালা, উঠোন, মন্দির, কুয়োতলা,
কুলুঙ্গি, ঘোরানো সিঁড়ি, বারান্দা, জলের কুঁজো।
কোথায় ময়নাটা ঠায় রাত্রি জাগে।
বুঝবার উপায় নেই কিছুই, অন্তত আমি কিছুই বুঝি না।
বাড়িটা ঘুমের মধ্যে হানাবাড়ি। তবু
দুয়ার ঠেললেই কেউ ভীষণ চেঁচিয়ে উঠবে, এখন আশঙ্কা হয়।
দুয়ার ঠেলি না, আমি সারা রাত্রি দেখি
খরস্রোত অন্ধকার বয়ে যায় ভিতর-বাড়িতে।
মল্লিকার মৃতদেহ
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। দেখেছি, উদ্যান
বড় শান্ত ভূমি নয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
ফুলে-ফুলে
তরুতে-তরুতে
লতায়-পাতায়
ভীষণ চক্রান্ত চলে; চক্ষের নিমেষে খুন রক্তপাত
নিঃশব্দে সমাধা হয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
যত না সৌন্দর্য, তার দশ গুণ বিভীষিকা।
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে কখনও
কেহ যেন শান্তির সন্ধানে আর নাহি যায়।
যাওয়া অর্থহীন; তার কারণ সেখানে
কিছু ফুল
নিতান্ত নিরীহ বটে, কিন্তু বাদবাকি
ফুলেরা হিংসুক বড়, আত্মরূপরটনায় তারা
যেমন উৎসাহী, তত বলবান, হত্যাপরায়ণ।
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে রূপের
অহঙ্কার ক্ষমাহীন। সেখানে রঙের
দাঙ্গায় নিহত হয় শত-শত দুর্বল কুসুম।
আজ প্রত্যুষেই আমি উদ্যানের বিখ্যাত ভিতরে
মল্লিকার মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি।
চক্ষু বিস্ফোরিত, দেহ ছিন্নভিন্ন, বুক
তখনও কি উষ্ণ ছিল মল্লিকার?
কার নখরের চিহ্ন মল্লিকার বুকে ছিল,
কে হত্যা করেছে তাকে, কিছুই জানি না।
কিন্তু গোপালের লতা অতখানি এগিয়ে তখন
পথের উপরে কেন ঝুঁকে ছিল?
এবং রঙ্গন কেন আমাকে দেখেই
অত্যন্ত নীরবে
হঠাৎ ফিরিয়ে নিল মুখ?
আমার বাগানে আরও কতগুলি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে?
মাটির মুরতি
তার মূর্তিখানি আজ গলে যায় রক্তের ভিতরে।
কাদায় বানানো মূর্তি; ললাট, নাসিকা,
চোয়াল, ওষ্ঠের ডৌল, নাভিমূল
ধীরে গলে যায়। চক্ষু গলে যায়। সব নির্মাণের
জোড় একে-একে আজ খুলে আসে। দম্ভের, ক্ষমার,
চতুর ফন্দির, শান্ত করুণার, হিংসার, প্রেমের
সমস্ত কড়ি ও বর্গা খসে পড়ে। যতনে যোজিত
উপাদানগুলি আজ পাতালগঙ্গায়
ভেসে যেতে থাকে। তার কাদার শরীর
মেদ মাংস ধীরে ধীরে রক্তের ভিতরে গলে যায়।
স্মৃতির ভিতরে কেউ পা ঝুলিয়ে কখনও বোসো না।
স্মৃতি বড় ভয়াবহ। স্মরণের গভীর পাতালে
লেগেই রয়েছে দাঙ্গা, খুন, রাহাজানি। নিশিদিন
স্মরণের গভীর পাতালে
রক্তের ভীষণ ঢেউ বহে যায়। পাহাড়প্রমাণ ঢেউ
স্মৃতির পাতাল থেকে উঠে আসে।
উঠে এসেছিল আজ। চোখের সমুখ থেকে
আর-একটি মূর্তিকে তারা লুফে নিয়ে গেল।
কাদায় বানানো মূর্তিখানি আজ পাতালগঙ্গায়
ভেসে চলে। ললাট, নাসিকা,
চোয়াল, কণ্ঠার হার, নাভিমূল, যতনে যোজিত
মাটির পেরেক-বল্টু রক্তের ভিতরে গলে যায়।
মিলিত মৃত্যু
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।
প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর কথা বলা যাক।
শুভেন্দু এবং সুধা কায়মনোবাক্যে এক হতে গিয়েছিল।
তারা বেঁচে নেই।
অথবা মৃন্ময় পাকড়াশি।
মৃন্ময় এবং মায়া নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেনি।
তারা বেঁচে নেই।
চিন্তায় একান্নবর্তী হতে গিয়ে কেউই বাঁচে না।
যে যার আপন রঙ্গে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
মিলিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
তা হলে দ্বিমত হওঁ। আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
তা হলে বিক্ষত হও তর্কের পাথরে।
তা হলে শানিত করো বুদ্ধির নখর।
প্রতিবাদ করো।
ঐ দ্যাখো কয়েকটি অতিবাদী স্থির
অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়।
পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি।
ওরা আর তাকাবে না ফিরে!
ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা
একমত হতে-হতে কুতুবের সিঁড়ি
বেয়ে উর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।
২৪ ফাল্গুন, ১৩৬৭
যবনিকা কম্পমান
কেহই কিংখাবে আর ঢাকে না বিরহ;
দাঁত নখ ইত্যাদি সবাই আজ
অনায়াসে দেখতে দেয়। পৃথিবীর নিখিল সন্ধ্যায়
গোপন থাকে না কিছু। যত কিছু
দেখিনি, এবারে সব দেখা হয়।
যেন পশুলোমে সব ঢাকা ছিল। গোলাপি কম্বল
তুলে নিলে স্পষ্ট হয় কিছু রক্ত, আর
পিত্তের সবুজ, পুঁজ, কফ, লালা,
গয়ের ইত্যাদি। সব গোলাপি কম্বলে চাপা দিয়ে
প্রত্যেকে দেখিয়েছিল এতকাল
গাঞী, গোত্র, মেল।
অর্থাৎ মার্জিত পরিভাষার সুন্দর যবনিকা।
যবনিকা কম্পমান। দেখে যান বার্ট্রাণ্ড রাসেল।
শব্দের পাথরে
জলের উপরে ঘুরে ঘুরে
জলের উপরে ঘুরে ঘুরে
ছোঁ মেরে মাছরাঙা ফের ফিরে গেল বৃক্ষের শাখায়।
ঠোঁটের ভিতরে তার ছোট্ট একটা মাছ ছিল।
কে জানে মাছরাঙা খুব সুখী কি না।
রোদ্দুরে ভীষণ পুড়ে পুড়ে
রোদ্দুরে ভীষণ পুড়ে পুড়ে
সন্ধ্যায় অনন্তলাল ফিরেছে অভ্যস্ত বিছানায়।
মস্তিষ্কে তখনও তার রূপকথার গাছ ছিল;
গাছের উপরে ছিল হিরামন পাখি।
কে জানে অনন্তলাল সুখী কি না।
শব্দের পাথরে মাথা খুঁড়ে
শব্দের পাথরে মাথা খুঁড়ে
কেউ কি কখনও মাছ, বৃক্ষ কিংবা পাখির কঙ্কাল পেয়ে যায়?
ভাবতেই ভীষণ হাসি পাচ্ছিল।
সূর্যাস্তের পর
সূর্য ডুবে যাবার পর
হাসির দমকে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেল,
গালের মাংস কাঁপতে লাগল,
বাঁ চোখ বুঁজে, ডান হাতের আঙুল মটকে
তারা বলল,
“শত্রুরা নিপাত যাক।”
আমি দেখলাম, দিগন্ত থেকে গুঁড়ি মেরে
ঠিক একটা শিকারি জন্তুর মতন
রাত্রি এগিয়ে আসছে।
বললাম, “রাত্রি হল।”
তারা বলল, “হোক।”
বললাম, “রাত্রিকে যেন একটা জন্তুর মতন দেখাচ্ছে।”
তারা বলল, “রাত্রি তো জন্তুই।
আমরা এখন উলঙ্গ হয়ে
ওই জন্তুর পূজায় বসব।
তুমি ফুল আনতে যাও।”
আমি ফুল আনতে যাচ্ছিলাম।
পিছন থেকে তারা আমাকে ডাকল।
বলল, “ফুলগুলিকে ঘাড় মুচড়ে নিয়ে আসবে।”
স্বর্গের পুতুল
কে কতটা নত হব, যেন সব স্থির করা আছে।
যেন প্রত্যেকেই তার উদ্বৃত্ত ভূমিকা অনুযায়ী
উজ্জ্বল আলোর নীচে নত হয়।
সম্রাট, সৈনিক, বেশ্যা, জাদুকর, শিল্পী ও কেরানি,
কবি, অধ্যাপক, কিংবা মাংসের দোকানে
যাকে নির্বিকার মুখে মৃত ছাগলের চামড়া ছাড়াতে দেখেছি,
এবং গর্দানে-রাংয়ে যে তখন মগ্ন হয়ে ছিল,
তারা প্রত্যেকেই আসে উজ্জ্বল আলোর নীচে একবার।
কপালে স্বেদের বিন্দু, সানন্দ সুঠাম ঘুরে গিয়ে
তারা প্রত্যেকেই নত হয়।
কেউ বেশি, কেউ কম, কিন্তু প্রত্যেকেই নত হবে
উজ্জ্বল আলোর নীচে একবার।
না-কেনা না-বেচা পণ্য, স্বর্গের তটিনী
সারাদিন জ্বলে;
এবং সৈনিক, বেশ্যা, কলাবিৎ, ভাড়াটিয়া গুণ্ডা, কারিগর
একবার সেখানে যায়, যে-যার ভূমিকা অনুযায়ী
নত হয়; স্বর্গ থেকে প্রলম্বিত আলোর সলিলে
মুখ প্রেক্ষালন করে নেয়।
ঘরের বাহিরে জ্বলে দৈব জলধারা;
দ্যাখো আলো জ্বলে, দ্যাখো আলোর তরঙ্গ জ্বলে, আলো–
সকালে দুপুরে সারাদিন।
স্বর্গের তটিনী জ্বলে, আলো জ্বলে, আলো,
যেখানে দাঁড়াও।
কে বড়বাজারে যাবে, দু’ গজ মার্কিন এনে দিয়ো;
কে যাও পারস্যে, এনো সুন্দর গালিচা;
কে যাও তটিনীতীরে স্বর্গের পুতুল,
কিছুই এনো না, তুমি যাও।