সুব্রত এতক্ষণে স্পষ্টই বুঝতে পারলে, লোকটা ঐ দলেরই একজন। তাকে ধাপ্পা দিয়েছে। বেমালুম। কিন্তু এখন সে কী করবে? যেমন করে তোক বাড়িটার মধ্যে তাকে আবার ঢুকতে হবে। হাত দিয়ে পকেট অনুভব করে দেখলে চাবির গোছা ঠিক আছে। সুব্রত তাড়াতাড়ি চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে হোটেল থেকে অন্ধকার গলিপথে বের হয়ে এল।
অন্ধকারে অলক্ষ্যে গলিপথে দাঁড়িয়ে সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার বেশ ভাল করে বাড়িটা দেখে নিল।
বাড়িটা অনেকখানি লম্বা। কিন্তু আগাগোড়া বাড়িটার সবটাই অন্ধকার। কোথাও কোন আলোর আভাস পর্যন্ত নেই।
সুব্রত গলিপথ ধরে এগুতে লাগল।
খানিকটা এগুবার পর ও আবার প্রশস্ত চিৎপুর রোডের ওপরে এসে পড়ল। হঠাৎ ও লক্ষ্য করলে, সেই বাড়িটা যার মধ্যে গতকাল রাত্রে প্রবেশ করে ও বন্দী হয়েছিল এবং সামনেই সেই দরজাটা, যেটায় গতকাল রাত্রে নিজহাতে সেই চাবি লাগিয়েছিল।
সুব্রত আর চিন্তামাত্র না করে তখুনি পকেট থেকে গতরাত্রের সেই চাবির গোছাটা বের করে একটু চেষ্টার পরই দরজা খুলে ফেললে।
নিঃশব্দে বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করলে সুব্রত।
অন্ধকার। একটা চাপা ভ্যাপসা দুর্গন্ধে নাক জ্বালা করে। পকেট থেকে টর্চটা বের করে ও। আলো জ্বালালে এবং টর্চের আলোয় ও নিঃশব্দে অগ্রসর হল।
গতরাত্রের সেই বন্ধ দরজাটার কাছে এসে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল।
টর্চ হাতে করে সুব্রত সেই দরজাপথে প্রবেশ করে দেখলে একটা খালি আবর্জনাপূর্ণ মাঝারি গাছের ঘর।
আলো ফেলে সুব্রত ঘরের চারপাশ ভাল করে দেখে নিল। আর একটা বন্ধ দরজা ওর নজরে পড়ল—সে দরজাটাও খোলাই ছিল, ঠেলতেই ফাঁক হয়ে গেল।
সামনেই একটা বারান্দা। বারান্দার এক কোণে প্রশস্ত সিঁড়ি ওর নজরে পড়ল। শিকারী বিড়ালের মত নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সিঁড়ি বেয়ে ও উঠতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই দেখলে নীচের তলার মতই আর একটি বারান্দা। কোন একটা ঘরের ঈষৎ ভেজানো দরজার ফাঁকে খানিকটা আলোর রশ্মি এসে বারান্দার ওপরে লুটিয়ে পড়ছে।
সুব্রত ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগল পা টিপে টিপে।
যে ঘর থেকে আলো আসছিল তারই পাশের ঘরের দরজাটা খোলাই আছে। কিন্তু ঘরের ভিতর প্রবেশ করে দেখল ঘরটা অন্ধকার। নিঃশব্দে ও ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
পাশের ঘরে যেন কাদের মৃদু কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার মাঝে একটা ভারী পর্দা ঝুলছে।
সুব্রত পা টিপে টিপে সেই পর্দার সামনে এসে দাঁড়াল।
ও দেখলে মাঝারি গোছের একখানি ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল পাতা, টেবিলের চারপাশে পাঁচ-ছয়জন লোক বসে। প্রথমেই ও লক্ষ্য করল, গতরাত্রের সেই সুবেশধারী বলিষ্ঠ ঢ্যাঙা লোকটা মাঝখানে বসে আছে। মানকে ও গোবরাও দলে আছে। বাকি দুজনকে ও চিনতে পরলে না। হঠাৎ ও দেখলে একটা ট্রেতে করে ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে একটি দশএগারো বছরের মেয়ে ঘরে প্রবেশ করল অন্য দিককার একটি পর্দা সরিয়ে।
মেয়েটার চেহারা অত্যন্ত রু। মুখখানি মলিন বিষণ্ণ। টানা-টানা ছলছল দুটি চোখ। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে। একমাথা রুক্ষ চুল এলোমেলো। দুহাতে একগাছি করে কাঁচের চুড়ি। পরিধানে ময়লা ঘেঁড়া একটি তাঁতের ড়ুরেশাড়ি।– মেয়েটি ট্রে হাতে করে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই সকলে এক এক করে হাত বাড়িয়ে এক একটি চায়ের কাপ তুলে নিতে লাগল!
ঢ্যাঙা লোকটি চায়ের কাপটা ট্রের ওপর থেকে তুলতে গিয়ে মেয়েটি একটু নড়ায় খানিকটা চা চকে লোকটার প্যান্টের ওপর পড়ে গেল। পরক্ষণেই লোকটা চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে গর্জন করে উঠলে, হারামদামী, চোখের মাথা খেয়েছিস?
মেয়েটি ভীত-চকিত করুণ দৃষ্টি মেলে ঢ্যাঙা লোকটার মুখের দিকে তাকাল।
একজন মোটা লোক ঢ্যাঙা লোকটার পাশেই বসেছিল, সে উঠে দাঁড়াল। তার মুখখানা তখন রাগে ফুলছে, সে খিটখিটে গলায় বললে, ফের তুই অসাবধান হয়ে কাজ করবি! কতদিন না তোকে সাবধান করেছি, সতর্ক হয়ে কাজ করতে! বলতে বলতে লোকটা এসে মেয়েটির চুলের মুঠি চেপে ধরল—আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
ওগো আমায় আর মেরো না গো আমায় আর মেরো না, আর অসাবধান হব না। তোমার। দুটি পায়ে পড়ি। করুণ কান্নায় মিনতিতে মেয়েটির কণ্ঠস্বর গুড়িয়ে গেল।
না, আজ আর তোর রক্ষে নেই। চল বলতে বলতে লোকটা মেয়েটির চুলের মুঠি চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সুব্রত সতর্ক হবার পূর্বেই এ ঘরে এসে ঢুকল।
মেয়েটির পিঠে দুম্ করে একটা কিল মারতেই মেয়েটি আর্তস্বরে কেঁদে উঠল।
সুব্রতর সর্বশরীর তখন রাগে ফুলছে। পাশের ঘরের লোকগুলি মেয়েটির করুণ চীৎকার শুনে হা হা করে হাসতে লাগল। আর নয়-সুব্রত বাঘের মতই লাফিয়ে পড়ে লোকটার নাকের ওপরে অন্ধকারেই লক্ষ্য করে এক ঘুষি বসালে। লোকটা অতর্কিতে ঘুষি খেয়ে প্রথমটায় ভয়ানক হকচকিয়ে গেল। কিন্তু সে সতর্ক হবার পূর্বেই সুব্রত একটা প্রচণ্ড লাথি বসাল লোকটার পেটে। একটা গ্যাক করে শব্দ করে লোকটা মুহূর্তে ধরাশায়ী হল।
এ ঘরে ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। লোকগুলো পাশের ঘর থেকে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুব্রত এক লাফ দিয়ে মেয়েটিকে নিজের পিছনে টেনে এনে দাঁড়াল তাকে আড়াল করে।
লোকগুলো যেন সুব্রতকে ঐ সময় ঐ ঘরে দেখে বিস্ময়ে একেবারে থ বনে গেছে।
ঢ্যাঙা লোকটাই সর্বপ্রথম কথা বললে, কী করছিস্ তোরা দাঁড়িয়ে! ধর ব্যাটাকে!