বলুন। মহেন্দ্রবাবুর চিঠিটা আপনি দেখেছেন?
হুঁ, দেখছি বৈকি। সেটাও ঠিক আপনিই একটা ত্রিকোণ কাগজে এমনি কতকগুলো অঙ্ক লেখা।
আপনার মনে আছে চিঠির অঙ্কগুলো?
না মনে নেই, তবে—
তবে?
আমি একটা কাগজে অঙ্কগুলো টুকে এনেছিলাম।
কেন?
কারণ ভেবেছিলাম—মানে তখনও তো আমার চিঠিটা আমি দেখিনি, যদি ঐ অঙ্কগুলোর কোন অর্থ বা সূত্র আমার চিঠি থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সে লিখেছিল আমরা যৌথভাবে যেন তার অর্থের দায়িত্ব নিই।
সে কাগজটা আছে—
আছে। দেখবেন?
আনুন তো!
মিঃ গাঙ্গুলী ভিতরে গিয়ে একটা মোটা অমনিবাস ডিটেকটিভ গল্পের বই নিয়ে এলেন। তার মধ্যে কাগজটা ছিল।
কাগজের মধ্যে অমনি কতকগুলো অঙ্ক। এবং সেটাও যদিও ত্রিকোণাকার-হয়ত এমনি হবে।
সুব্রত পাশাপাশি দুটো কাগজ রেখে একবার দুবার তিনবার লেখাগুলো পড়ল, অঙ্কগুলোর কোন অর্থ যদি বের করা যায়। কিন্তু কোন হদিসই যেন পায় না সুব্রত।
পারবেন না মশাই, পারবেন না। মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, আমিও অনেক ভেবেছিদু দিন দু রাত, কিন্তু কেন হদিসই করতে পারিনি।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন কি, আপনার বন্ধুর হাতে অনেক টাকা ছিল?
করি—কারণ নলিন ছিল যেমন সত্যবাদী তেমনি সিরিয়াস টাইপের মানুষ এবং মধ্যে মধ্যে তার অসামান্য চরিত্রের মধ্যে যে একটা সহজ কৌতুক প্রকাশ পেত।
কৌতুক!
এটা আর কৌতুক ছাড়া কি বলুন তো?
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী!
বলুন।
আপনাদের এই চিঠির ব্যাপার আর কেউ জানে?
না। আমরা দুই বন্ধু ছাড়া আর কে জানবে!
আচ্ছা, ডাঃ চৌধুরীর আপনার বলতে তো তার একমাত্র ভাগ্নে ডাঃ নীরেন সান্যাল এবং তিনিই তো ডাঃ চৌধুরীর সব কিছু পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?
থাকবে না কেন? ভেরি নাইস বয়-যেমন ভদ্র তেমনি বিনয়ী।
তিনি আপনার বন্ধুর এই চিঠির কথা জানতেন না?
না।
আপনারাও বলেননি?
না, প্রয়োজন মনে করিনি।
কেন প্রয়োজন বোধ করেননি?
কারণ তাকে যদি নলিনীর জানাবার ইচ্ছাই থাকত তবে আমাদের দুই বন্ধুকে বা কেন এত সাবধানতার সঙ্গে ব্যাপারটা জানিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আমাদের দুজনকে ছাড়া আর কেউ জানুক তার ইচ্ছা ছিল না।
আচ্ছা আপনি কি সত্যিই মনে করেন মিঃ গাঙ্গুলী, চিঠির এই অঙ্কগুলোর মধ্যে থেকে আপনার বন্ধু মিঃ রায়ও কোন কিছু বের করতে পারেননি?
না। আমি বা মহেন্দ্র কেউ ওর কোন মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি।
আচ্ছা একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী, সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, আপনি ও মহেন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই মিঃ চৌধুরীর ঐ চিঠির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন?
তা করেছি।
তাহলে সে-সময়ও তো কেউ আপনাদের আলোচনা শুনে চিঠির ব্যাপারটা জানতে পারে!
সে আর এমন অসম্ভব কি?
আর একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী—
বলুন। আপনি তো মধ্যে মধ্যে বাড়ি থেকে বের হন?
বিশেষ না—তবে–
তবে?
মধ্যে মধ্যে কলোনীতে যে পান্থনিবাস রেস্টুরেন্টটা আছে—সেখানে গিয়ে বসি। পান্থনিবাসের প্রোপ্রাইটার ঋষি লোকটা চমৎকার কফি বানায়—সেই কফির লোভেই মধ্যে মধ্যে সেখানে যাই। তাছাড়া কোথাও বড় একটা আমি যাই না।
সাধারণত কখন রাত্রে শোন?
তা রাত দশটা।
সেদিন—মানে শনিবারও রাত দশটায়ই শুতে গিয়েছিলেন?
না, সেদিন একটু আগেই যাই-রাত সাড়ে নটায়। বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে কদিন। সেদিন আবার ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল।
তাই। আচ্ছা, সেদিন পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কতক্ষণ ছিলেন?
সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। দোকানে লোকজন ছিল না তেমন। আমি আর ঋষি বসে বসে গল্প করছিলাম।
ঋষির সঙ্গে আপনার তাহলে বেশ আলাপ আছে?
তা আছে। আঠারো বছর বয়সের সময় লোকটা জাহাজের খালাসী হয়ে বিলেত যায়। সেখানে বছর চল্লিশ ছিল। তারপর বিশ্রী একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে ও আর ওর বর্মিনী স্ত্রী
বর্মিনী স্ত্রী নাকি লোকটার?
হ্যাঁ, মালার বাবাও বিলেতে মশলার একটা দোকান করেছিল। সেখানে চাল ডাল সব কিছু পাওয়া যেত। ঋষি ঐ দোকানে চাল ডাল কিনতে যেত, দুজনায় আলাপ হয়–তারপর বিয়ে হয়।
তারপর ঋষির কথা বলুন, কি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল বলছিলেন?
হ্যাঁ—অ্যারেস্ট হবার আগেই সে ও তার বর্মিনী স্ত্রী কৌশলে বিলেত থেকে পালায়–তারপর হংকং হয়ে যুদ্ধের ঠিক শুরুতে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছায়। তারপর এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে আগরপাড়ার এই কলোনীতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করেছে। সেই বাড়িরই বাইরের অংশে একটা রেস্তোরাঁ খুলেছে। রেস্তোরাঁর প্রধান আকর্ষণই ঐ কফি :
হুঁ , তাহলে আপনি সেদিন ছটার পর ফিরে আসেন—সোজা বাড়িতেই তো আসেন?
, একটু এদিক ওদিক ঘুরেছি। ঠাণ্ডা চিরদিনই আমার ভাল লাগে।
কখন তাহলে ফিরলেন বাড়িতে?
রাত সোয়া আটটা প্রায়।
আচ্ছা আজ তাহলে আমরা উঠব মিঃ গাঙ্গুলী, হয়ত আবারও আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে পারি। মৃণাল সেন বলল।
না, না—বিরক্ত কি, আসবেন—নিশ্চয়ই আসবেন, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।
.
০৮.
সবাই উঠে পড়েছিল, হঠাৎ সুব্রত বলে, মিঃ গাঙ্গুলী, আপনার এই চিঠিটা আর ঐ কপিটা আমি নিতে পারি? এ দুটো কপি করে দু-এক দিনের মধ্যেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।
বেশ তো-নিয়ে যান!
আচ্ছা তাহলে চলি–নমস্কার।
নমস্কার। সকলে সলিটারি কর্নার থেকে বের হয়ে এল।
গেট দিয়ে বের হয়ে সকলে এসে গাড়িতে উঠে বসল।