ওরা ডাকবে কি ডাকবে না ইতস্তত করছে এমন সময় মধ্যবয়সী একটা ভৃত্য বের হয়ে এল পর্দা তুলে ঘর থেকে।
পরনে তার পরিষ্কার ধুতি ও ফতুয়া।
কাকে চান?
মিঃ গাঙ্গুলী বাড়িতে আছেন?
হ্যাঁ। সাহেব বাড়িতেই আছেন।
জলধর চাটুজ্যেই কথা বললেন, সাহেবকে খবর দাও, বলগে কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন, দেখা করত চান।
সাহেব তো এসময় কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
বল গিয়ে থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন।
ভৃত্য এবার আর কোন প্রতিবাদ করল না। ওদের বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে খবর দিতে গেল।
ছোট ড্রইংরুম কিন্তু পরিপাটি ভাবে সাজানো। গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
একটু পরেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। পরনের পায়জামা ও ড্রেসিং গাউন। পায়ে চপ্পল। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল কিন্তু বেশির ভাগই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখখানা রুক্ষ। চোয়ালের হাড় দুটো ব-এর আকারে দুপাশে ঠেলে উঠেছে। চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। লম্বা বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। বুকের ও হাতের পেশীগুলো সজাগ। দৈহিক শক্তিরই পরিচয় দেয়।
আপনারা! ভদ্রলোকই প্রশ্ন করলেন।
কথা বললেন জলধর চাটুজ্যে, আপনিই বোধ হয় মিঃ গাঙ্গুলী?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা–
আমি এখানকার থানার ও. সি. আর ইনি লালবাজার থেকে আসছেন, ইন্সপেক্টার মৃণাল সেন। জলধর চাটুজ্যে বললেন।
মিঃ গাঙ্গুলীর চোখের দৃষ্টি কুঞ্চিত হল যেন।
আমার কাছে কি কোন দরকার ছিল?
হ্যাঁ। নচেৎ আসব কেন বলুন! মৃদু হেসে জলধর চাটুজ্যে বলেন কথাটা।
কি দরকার বলুন তো।
বসুন!
মিঃ গাঙ্গুলী বসলেন একটা সোফায়।
বলুন।
মিঃ গাঙ্গুলী, কলকাতার রায় অ্যান্ড কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মিঃ এম. এন রায়কে আপনি তো চেনেন? কথাটা বলে মৃণাল সেনই।
হ্যাঁ—সে আমার বিশেষ বন্ধু। কিন্তু কি ব্যাপার?
আপনার এখানে গত শনিবার তার আসার কথা ছিল, মানে আপনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কথা বলে এবারে সুব্রত।
আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম মহেন্দ্রকে?
হ্যাঁ—চিঠি দিয়ে!
হোয়াট ননসেন্স—আমি আবার তাকে কবে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালাম।
সে কি? আপনি ডেকে পাঠাননি চিঠি দিয়ে? সুব্রত কথাটা পুনরাবৃত্তি করে।
মোটেই না।
সুব্রত এবার চিঠিটা বের করে দেয়।-দেখুন তো এই চিঠিটা।
চিঠিটা গাঙ্গুলী হাতে করে নিয়ে দেখলেন। পড়লেন, তারপর বললেন, ফানি! এ চিঠি আপনারা কোথায় পেলেন?
এ চিঠি আপনার লেখা তো?
কস্মিনকালেও নয়।
আপনার নয়?
নিশ্চয়ই নয়। প্রথমত আমার বাড়িতে কোন টাইপরাইটিং মেসিন নেই। দ্বিতীয়ত টাইপ করতেই আমি জানি না আর এ যদিও হুবহু প্রায় নকল করার চেষ্টা হয়েছে তবু এটা আমার সই নয়। কিন্তু এ চিঠি কোথা থেকে আপনারা পেলেন?
বলছি—
আচ্ছা মিঃ রায়ের সঙ্গে আপনার শেষ দেখা কবে হয়েছিল?
গত মাসে। মাসের প্রথম দিকে কলকাতায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানে অফিসে গিয়ে দেখা করি।
তারপর আর দেখা হয়নি?
না।
তার কোন খবর জানেন না?
না। কিন্তু কি ব্যাপার? এনিথিং রং!
গতকালের সংবাদপত্র পড়েন নি?
সংবাদপত্র আমি পড়ি না। কিন্তু ব্যাপার কি?
গত শনিবার আপনার বন্ধু মিঃ রায় এখানে এই আগরপাড়ায় কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন!
হোয়াট? কি—কি বললেন? গাঙ্গুলী যেন অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন, মহেন্দ্র খুন হয়েছে? সে নেই? না, না-এ আপনি কি বলছেন!
দুঃখের সঙ্গেই বলছি কথাটা মিথ্যা নয় মিঃ গাঙ্গুলী।
আমার-আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ইন্সপেক্টার। মহেন্দ্র হ্যাজ বিন কিল্ড। আর আমারই বাড়ি থেকে কিছু দূরে তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী! সুব্রত এবার কথা বলে।
কিন্তু মিঃ গাঙ্গুলী কোন সাড়া দিলেন না। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, নলিনী আগেই গেছে। মহেন্দ্রও চলে গেল। বাকি রইলাম আমি। বুঝতে পারছি আমার যাবার সময় হয়েছে। আমার দিনও হয়ত ফুরিয়ে এসেছে।
.
০৭.
মিঃ গাঙ্গুলী। আবার ডাকে সুব্রত।
জানেন ইন্সপেক্টার, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের-নলিনী গেল ক্যানসারে আর মহেন্দ্র গেল পিস্তলের গুলিতে।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, ঐ চিঠিটার মধ্যে যে একটা চিঠির কথা আছে—
হ্যাঁ—ঐ এক বিচিত্র ব্যাপার!
কি রকম?
চিঠিটা আমি ব্যাঙ্ক থেকে দিনসাতেক হল এনেছি। চিঠি ঠিক বলব না। একটা ত্রিকোণাকার কাগজের টুকরোর মধ্যে পর পর কতগুলো অঙ্ক বসানো।
অঙ্ক!
হ্যাঁ।
দেখতে পারি চিঠিটা?
হ্যাঁ, বসুন, আনছি।
মিঃ গাঙ্গুল ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা সিলমোহর ভাঙা লম্বা লেফাফা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন।
এই দেখুন এর মধ্যেই আছে সে কাগজ।
সুব্রত হাত বাড়িয়ে লেফাফাটা নিল–-উপরে ইংরাজীতে লেখা—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী। কোণে লাল কালিতে লেখা পারসোন্যাল।
সুব্রত খাম থেকে কাগজটা বের করল।
মিথ্যে নয়, সত্যিই ত্রিকোণাকার একটা কাগজ এবং তার মধ্যে পর পর কতকগুলো অঙ্ক বসানো। আর নিচের কোণে ইংরাজীতে লেখা অ্যালফাবেট।
মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, দেখলেন তো, আমি তো মশাই ওর মাথামুণ্ডু অর্থ কিছুই খুঁজে বের করতে পারিনি। অথচ মজা কি জানেন, নলিনের মত লোক মরার আগে যে আমাদের সঙ্গে একটা ঠাট্টা-তামাসা করে গিয়েছে তাও ভাবতে পারা যায় না।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী।