তবে দিলেন না কেন?
তা জানি না। হয়ত বন্ধুদের যত বিশ্বাস করতেন ভাগ্নেকে ততটা করতেন না।
আচ্ছা, আপনি বলছেন বিপুল অর্থ নাকি ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরী বর্মা থেকে সঙ্গে করে এনেছিলেন—সে অর্থ কত?
সে এক মশাই বিচিত্র ব্যাপার।
কি রকম?
ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরীর বিপুল অর্থের কথাই শুনেছি কিন্তু সে কি নগদ টাকাকড়ি না অন্য কিছু তাও এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। এবং সেই অর্থ কোথায় আছে-–আদৌ আছে কিনা—কি ব্যাপার—সেও একটা রহস্যের মত।
কি রকম?
আপনাকে তো আগেই বলেছি, ডাঃ চৌধুরী মানুষটা যেমন খেয়ালী তেমনি রহস্যপ্রিয় ছিলেন। তাঁর চিঠির মধ্যে ছিল ব্যাঙ্ক থেকে নির্দেশ নিতে তার অর্থ সম্পর্কে। ব্যাংকে খোঁজ করতে দেখা গেল
কি?
দু বন্ধুর নামে দুখানা চিঠি আছে আলাদা আলাদা ভাবে—এবং সে চিঠির মধ্যে কতকগুলো অঙ্ক পর পর বসানো কেবল।
অঙ্ক!
হাসে চিঠি আমিও মিঃ রায়ের কাছে দেখেছি। আর একটা জিনিস–
কি?
চিঠির কাগজটা কোনোকুনি ত্রিকোণাকার ভাবে যেন কাঁচি দিয়ে কাটা।
সে আবার কি!
তাই। আর সম্ভবত ঐ চিঠির কথাই লিখেছেন মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের স্যারের কাছে এবং চিঠির ব্যাপারটা আলোচনার জন্যই হয়ত ডেকেছেন—কিন্তু মিঃ সেন, এখনও আপনি বললেন না তো-স্যারের ব্যাগটা আপনি কোথায় পেলেন?
মিঃ মুখার্জী, আমি অতীব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি, মিঃ রায় বোধ হয় আর বেঁচে নেই।
সে কি! বিস্ময়ে মিঃ মুখার্জী যেন একেবারে থ হয়ে যান।
হ্যাঁ—যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয় ট্রেন-অ্যাক্সিডেন্টে সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
না, না—আই কানট বিলিভ ইট-এ যে কিছুতেই আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না—
মৃণাল সেন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ডেড বডিটা এখনও মর্গেই আছে—আইডেন্টিফিকেশন-এর জন্য আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে। ভাল কথা, তার ছেলেমেয়ে আছে তো—তার স্ত্রী–
অনেক দিন আগেই তার স্ত্রী মৃত্যু হয়েছে।–
স্ত্রী তাহলে নেই?
না।
ছেলেমেয়ে?
দুই ছেলে এক মেয়ে। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না!
সম্পর্ক ছিল না?
না। অল্প বয়সে স্ত্রীর মৃত্যু হয়—তারপর থেকেই তার ছেলেমেয়েরা তাদের মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে-যদিও মোটা একটা মাসোহারা বরাবরই তাদের জন্য গেছে। কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত।
ছেলেমেয়েরা এখনও কি তাদের মামার বাড়িতেই আছে?
না—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র ডাক্তার-বর্তমানে সে ইস্টার্ন ফ্রন্টে ইমারজেন্সি কমিশনে আছে-ক্যাপ্টেন। ছোট ভবেন্দ্র-সে বি. কম. পাস করতে না পেরে বছরখানেক হল–সেও বাপের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যুদ্ধের চাকরি নিয়েছে। বেরিল না কোথায় আছে যেন শুনেছি-সুবেদার মেজর–
আর মেয়ে?
মেয়ে কুন্তলা বছর দেড়েক হল মামীর মৃত্যুর পর বাপের কাছে চলে এসেছে। এম. এ. পড়ে
বাড়িতে তাহলে ঐ এক মেয়ে আর তিনিই ছিলেন?
না—আর একজন ছোট ভাই আছেন মিঃ রায়ের।
ভাই?
হ্যাঁ, সুরেন্দ্রনাথ। লেখাপড়া বিশেষ কিছু করেনি। আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে এখন একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। অত্যন্ত বেহিসাবী উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ।
হুঁ–তাহলে তো দেখছি একমাত্র আপনি ছাড়া আর উপায় নেই। চলুন আপনাকে দিয়েই মৃতদেহ আপাতত আইডেন্টিফাই করিয়ে নেওয়া যাক। হ্যাঁ আর একটা কথা–আপাতত অফিসে কাউকে ব্যাপারটা জানাবেন না কিন্তু–
বেশ।
অফিসের গাড়িতেই দুজনে বের হয়।
পথে যেতে যেতে একসময় মৃণাল শুধায়, মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের কোন উইল আছে কিনা জানেন?
এ্যা-কিছুদিন আগেই তিনি উইল করেছেন। আমি উইলের একজন সাক্ষী। তাহলে তো উইল সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু জানেন?
জানি। কিন্তু সে সম্পর্কে আপাতত কিছু আপনাকে আমি বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।
বলতে পারছেন না কেন?
সেই রকম নির্দেশই আছে—আর সত্যিই যদি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়ে থাকে, কালপরশুই তো সব জানতে পারবেন উইলের ব্যাপারে।
মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
মিঃ মুখার্জীই আবার এক সময় প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মিঃ সেন, অ্যাক্সিডেন্টে মিঃ রায়ের মৃত্যু হয়েছে বলছেন—ট্রেনে কাটা পড়ছেন কি?
তা এখনও ঠিক বলা যাচ্ছে না। মৃণাল সেন বলে।
মর্গে গিয়ে মৃতদেহ দেখবার পর মিঃ মুখার্জী কেঁদে ফেললেন। মুখটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও মুখার্জীর চিনতে কষ্ট হয় না মানুষটাকে!
বললেন, মৃতদেহটা তার মনিবেরই বটে। মিঃ মুখার্জীকে বিদায় দিয়ে মৃণাল সেন লালবাজারে ফিরে এল।
.
০৫.
পরের দিন কলকাতার ইংরাজী ও বাংলা সমস্ত দৈনিক কাগজেই লক্ষপতি বিজনেস ম্যাগনেট-রায় এন্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মহেন্দ্রনাথ রায়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদটা তার ফটোসহ প্রকাশিত হল।
মহেন্দ্রনাথ যে কেবল লক্ষপতি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাই নয়—তার দানধ্যানও যথেষ্ট ছিল এবং একজন দেশকর্মী বলেও তার পরিচয় ছিল।
সকাল তখন নয়টা হবে।
মৃণাল তার অফিস কামরায় ঢুকতে যাচ্ছে, সার্জেন্ট সাহা এসে বললেন, স্যার, আপনাকে ডি. সি. মিঃ চক্রবর্তী দুবার খোঁজ করেছেন।
মৃণাল কোন কথা না বলে ডি. সি.-র ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ডি. সি.-র পাশেই একজন মধ্যবয়সী যুবক বসে ছিল-কালো সুশ্রী চেহারা। মৃণাল ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে মৃণাল, এস পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি সুব্রত রায়।