তার ড্রাইভার রামরূপবয়েস অনেক হয়েছে, রাতে ভাল করে চোখে দেখতে পায় না—তাই তিনি রাত্রে কখনও ওকে নিয়ে বেরুতেন না। কোথায়ও যেতে হলে ট্যাকশিতেই যেতেন।
আশ্চর্য তো।
তাই। লোকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছে। ভাল করে চোখে দেখে না। তবু তাকে ছাড়াবেন। আমরা কতবার বলেছি একটা ভাল দেখে ড্রাইবার রাখুন। কিন্তু তিনি কারও কথাই শোনেন নি। বলেন, ও এতকাল আমার কাছে কাজ করল –এখনও চমৎকার গাড়ি চালায়—কেবল রাত্রে একটু কম দেখে—সেই অজুহাতে ওকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি না এই বয়সে। সেটা অন্যায় হবে। তাছাড়া আমি তো রাত্রে বড় একটা বেরই হই না।
লোকটাকে খুব স্নেহ করেন মিঃ রায় মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ—রামরূপেরও স্যারের উপরে অগাধ ভালবাসা ও ভক্তি। তাছাড়া লোকটার আরও একটা গুণ হচ্ছে, অত্যন্ত বিশ্বাসী। অমন বিশ্বাসী লোক আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না।
হুঁ-তাহলে তিনি ট্রেনেই গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আর একটা কথা—মিঃ গাঙ্গুলী ওঁর বিশেষ বন্ধু বলেই মনে হয়—
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তিন বন্ধু ছিলেন। এক বন্ধু গত হয়েছেন। এখন দুই বন্ধু আছেন। মিঃ রায় আর আগরপাড়ার ঐ মিঃ গাঙ্গুলী।
অনেক দিনের বন্ধুত্ব বুঝি ওঁদের?
হ্যাঁ–মিঃ রায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই বন্ধু ছিলেন ওঁরা। মহেন্দ্রনাথ রায়, মণীন্দ্র গাঙ্গুলী আর ডাঃ নলিনী চৌধুরী।
নলিনী চৌধুরী নেই?
না।
আচ্ছা মিঃ মুখার্জী-মিঃ গাঙ্গুলী যে চিঠির মধ্যে লিখেছেন কি একটা চিঠির কথা–তিনি ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে কিছু জানেন?
জানি, সে এক মজার ব্যাপার।
কি রকম?
তাহলে আপনাকে ঐ চিঠির ব্যাপারটা মোটামুটি বলতে হয়। ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে মিঃ রায়ের অবস্থাই সব চাইতে ভাল তার ব্যবসার দৌলতে।
এ ব্যবসা কি তারই হাতের?
না।
তবে?
তার বাপেরই তৈরি, বিরাট লাভবান ব্যবসা। অবশ্য তার পরিশ্রমও এতে কম নেই।
মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী সিঙ্গাপুরে ভাল চাকরি করতেন। যুদ্ধ বাধার পর বোমা পড়তে শুরু হলে সেখান থেকে কোনমতে নিঃস্ব কপর্দকহীন অবস্থায় প্রাণটা মাত্র হাতে করে মালয় ও বর্মা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেশে ফিরে আসেন। এসে কিছুদিন আমাদের স্যারের বালীগঞ্জের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর স্যারের কাছ থেকেই। কিছু টাকা নিয়ে আগরপাড়ায় দেশবন্ধু কলোনিতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করে বসবাস করছেন। ডাঃ নলিনী চৌধুরী-তিন বন্ধুর মধ্যে একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন বরাবর। নিজের ছোটখাটো একটা ল্যাবোরেটারি ছিল, সেখানে সর্বক্ষণ বসে বসে রিসার্চ করতেন। মাসকয়েক হল তিনি মারা গেছেন ব্ল্যাড-ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে।
তার ছেলেমেয়ে নেই?
না, মিঃ চৌধুরী ও মিঃ গাঙ্গুলী বিয়েই করেননি। দুজনেই ব্যাচিলার।
চিঠির কথা কি বলছিলেন?
ডাঃ চৌধুরীর এক ভ্রাতা হেমন্ত চৌধুরী ছিলেন বর্মায়। শোনা যায়, যুদ্ধ বাধার সঙ্গেই তিনিও দেশে ফিরে আসেন। এবং আসবার সময় নাকি প্রভূত অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসেন। যাহোক, এসে তিনি শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। এবং দেশে ফিরে আসার মাস আষ্টেক পরে হঠাৎ একদিন রাত্রে ঘরের মধ্যে সর্পদংশনে তার মৃত্যু হয়।
সর্পদংশনে মৃত্যু!
সেই রকমই শুনেছি। ডাঃ চৌধুরীর দাদা তার মৃত্যুর দিন দশেক আগে ডাঃ চৌধুরী–তার ছোট ভাইকে শ্রীরামপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠান, এবং ঐ সময়ই তিনি তার ছোট ভাইকে প্রথম বলেন যে বর্মা থেকে আসবার সময় তিনি প্রভূত অর্থ নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। সেই অর্থ তিনি তার ভাইকে দিয়ে যেতে চান—সেই অর্থ দিয়ে যেন ডাঃ চৌধুরী তার আজন্মের বাসনা-মনের মত একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করে তার ইচ্ছামত রিসার্চ চালিয়ে যান।
তারপর?
কিন্তু তাঁর সে বাসনা পূর্ণ হল না। দাদার মৃত্যুর মাস কয়েক আগে থাকতেই ডাঃ চৌধুরীর শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি ক্ষেপ করেন নি। দাদার মৃত্যুর দিন পনেরো-কুড়ি বাদে হঠাৎ ধরা পড়ল তার লিউকিমিয়া, ব্লাড ক্যানসার হয়েছেডাঃ চৌধুরী শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। মিঃ রায় সে সময় ইউরোপে। প্রত্যহই প্রায় তিনি খোঁজ নিতেন মিঃ রায় ফিরেছেন কিনা। মিঃ রায়ের ইউরোপ থেকে ফিরবার আগেই ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হল। ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যুর দিন পনেরো বাদে মিঃ রায় দেশে ফিরে এলেন এবং তার ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই একদিন অফিসে ডাঃ চৌধুরীর লএডভাইসার কালীপদবাবু মিঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে দুখানা চিঠি তাঁর হাতে দিলেন। একখানা তার নামে, অন্যটা তাদের বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। এবং চিঠি দুটো দিয়ে তিনি বললেন, তার মৃত ক্লায়েন্টের নির্দেশমতই তিনি ঐ চিঠি দিলেন।
.
০৪.
তারপর।
মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন–
মিঃ রায়ের মুখেই শোনা আমার কথাগুলো। ডাঃ চৌধুরীর দুখানা চিঠি একখানা স্যারের নামে, অন্যখানা মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। চিঠিতে ছিল—বরাবরের যাঁর ইচ্ছা ছিল বিরাট একটা ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলবেন কিন্তু অর্থের জন্য পারেন নিশেষটায় সেই অর্থ এল যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়—যাই হোক, সেই অর্থের দায়িত্ব তিনি তার দুই বন্ধুর হাতে যৌথভাবে তুলে দিয়ে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি নিয়ে তারা যেন ঐ অর্থ দিয়ে ভাল একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করেন। ভারটা অবিশ্যি তিনি তার ভাগ্নের হাতেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু কেন যে দেন নি তা তিনিই জানেন—যদিও তার নিজস্ব ল্যাবোরেটারিটা তিনি ঐ ভাগ্নেকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্নেকে তিনি ভালও বাসতেন যথেষ্ট এবং ঐ ভাগ্নে তার সঙ্গেই বরাবর কাজও করেছে।