মৃণাল বেয়ারার সঙ্গে গিয়ে ম্যানেজারের অফিসে প্রবেশ করল।
দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। মোটাসোটা বেশ ভারিক্কী চেহারা। পরিধানে সাহেবী পোশাক-মুখে পাইপ। চোখে সুদৃশ্য ফ্রেমের চশমা।
বি সিটেড প্লিজ!!
মিঃ মুখার্জী কি একটা ফাইল দেখছিলেন—চোখ তুললেন না—মৃদুকণ্ঠে মৃণালকে বসতে বললেন।
মৃণাল বসল।
ফাইলটা দেখা হল একটু পরে-সেটা একপাশে ঠেলে রেখে মুখ তুলে তাকালেন মিঃ মুখার্জী।
ইয়েস মিঃ সেন, হোয়াট ক্যান ড়ু ফর ইউ।
আমি লালবাজার থেকে আসছি। কথাটা বলে মৃণাল তার পরিচয় দিল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মুখাজীর দুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। কয়েকটা মুহূর্ত মৃণালের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলেন, লালবাজার থেকে আসছেন—কি ব্যাপার বলুন তো?
মিঃ এম. এন. রায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
আমাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের সঙ্গে?
তিনিই কি ম্যানেজিং ডাইরেক্টার?
হ্যাঁ,–কিন্তু তিনি তো আজ এখনও আফিসে আসেন নি!
আসেন নি?
না।
ও, তা সাধারণত কখন অফিসে আসেন তিনি?
ঠিক দশটায় আসেন—অত্যন্ত পাংচুয়াল তিনি—অথচ আজ এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল—এলেন না। তাই ভাবছিলাম
অসুখ-বিসুখ করেনি তো!
না, না, মশাই-ভদ্রলোকের যদিও ষাট বছর বয়স হল—কখনও আজ পর্যন্ত একটা দিনের জন্যও তাকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে আগরপাড়ায় তার বন্ধুর ওখানে গিয়ে যদি আটকে পড়ে থাকেন কোন কারণে
আগরপাড়ায়—তিনি আগরপাড়ায় কাল গিয়েছেন নাকি? মৃণাল প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কোন ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার কি?
না-না, তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় থাকে। তার এক জরুরী চিঠি পেয়ে—
জরুরী চিঠি?
হ্যাঁ—এক ভদ্রলোক গতকাল বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ চিঠিটা নিয়ে আসে—সেই চিঠি পড়ার পরই তিনি আমাকে বলেন—তিনি অফিসের পর আগরপাড়া যাবেন।
চিঠিটায় কি ছিল কিছু আপনি জানেন?
চিঠিটা তিনি সঙ্গে নিয়ে যাননি—সম্ভবত তার টেবিলের উপরেই এখনও পড়ে আছে।
কি করে আপনি সেকথা জানলেন?
আমি সে সময় তার ঘরে তার পাশেই বসেছিলাম—চিঠিটা তিনি পড়া হলে টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন দেখলাম—তারপর বের হয়ে গেলেন।
হুঁ-আচ্ছা দেখুন তো এই পার্সটা-বলতে বলতে মৃণাল সেন জলধর চাটুজ্যের কাছ থেকে পাওয়া পার্সটা পকেট থেকে বের করে মিঃ মুখার্জীকে দেখান।
একি, এ তো মিঃ রায়েরই পার্স! এটা আপনি পেলেন কোথায়?
আর ইউ সিয়োর—ঠিক জানেন?
ঠিক জানি মানে—এ পার্সটা তার ৫৯তম বার্থ-ডেতে আমিই তাকে প্রেজেন্ট করেছিলাম যে—কিন্তু এ পার্সটা আপনি কোথায় পেলেন?
মিঃ মুখার্জীর গলার স্বরে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পায় যেন।
তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে এ পার্সটা আপনাদের ম্যানেজিং মিঃ এম. এন. রায়েরই?
হ্যাঁ—কিন্তু মিঃ সেন, আপনি তোকই বললেন না, মিঃ রায়ের এ পার্সটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?
বলছি সব কিছুই, ব্যস্ত হবেন না মিঃ মুখার্জী-তার আগে একবার মিঃ রায়ের অফিসঘরটা আমি দেখতে চাই—আর সেই চিঠিটা যদি পাওয়া যায় একবার সেটাও দেখব।
চলুন।
মিঃ মুখার্জী উঠে দাঁড়ান।
পাশের ঘরটাই ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের বসবার ঘর।
বেয়ারা দরজার গোড়ায় টুলের উপরে বসেছিল।
মিঃ মুখার্জীকে দেখে তাড়াতাড়ি সেলাম দিয়ে বলে, বড়া সাক্ তো আভি আয়া নেই সাব!
ঠিক হ্যায়-মুঝে মালুম হ্যায়।
মিঃ মুখার্জী মৃণাল সেনকে নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
টেবিলের উপরেই চিঠিটা পাওয়া গেল। একটা পেপার-ওয়েট দিয়ে অন্যান্য চিঠিপত্রের সঙ্গে চাপা দেওয়া রয়েছে চিঠিটা।
তুলে নিল হাতে মৃণাল সেন চিঠিটা!
চিঠিটা ইংরাজীতে টাইপ করা। পুরু সাদা লেটার প্যাডের কোণে ইংরাজী এম অক্ষরটি মনোগ্রাম করা।
নিচে নাম সই করা, অ্যাফেকশনেটলি—ইওরস মণি।
চিঠিটার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায় :
৩০/৩/৪৩
প্রিয় মহেন,
অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। ধন্যবাদ দিয়ে তোমায় ছোট করব না। তবে তোমার সৌজন্যে বর্তমানে আমার আরামেই কাটছে এখানে। সামনের শনিবার যদি একবার আসো তাহলে ভাল হয়—এবং আসবার সময় তোমার সেই চিঠিটা যদি আনো তাহলে আমরা ব্যাপারটা একটু আলোচনা করতে পারি, কারণ আমি গত পরশু ব্যাঙ্ক থেকে আমার চিঠিটা আনিয়েছি।
যদিও আগে তুমি কখনও এখানে আসনি, তাহলেও এখানে আসতে তোমার কোন কষ্ট হবে না। ইচ্ছা করলে গাড়িতেও আসতে পার বা ট্রেনেও আসতে পার—তবে রাতটা কিন্তু ছাড়ছি না। গাড়িতে যদি আসো, তাহলে স্টেশন থেকে উত্তর-মুখো যে পথটা গেছে সেই পথ ধর এগিয়ে এলেই দেশবন্ধু কলোনিতে এসে পৌঁছতে পারবে। আর ট্রেনে যদি আসো তো–একটা রিকশা নিয়ে ঐ পথটা দিয়ে আসতে পার।
স্টেশন থেকে দেশবন্ধু কলোনি প্রায় মাইলখানেক হবে। পথটা ধরে সোজা এগিয়ে এলে একটা রেস্তোরাঁ দেখবে-নামটা তার বিচিত্ৰ-পান্থনিবাস—সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও আমার সলিটারি কর্নার তারা দেখিয়ে দেবে।
ভালবাসা নিয়ো—আসবে কিন্তু—আসা চাই-ই। আমি অপেক্ষা করব।
তোমার স্নেহধন্য-মণি।
মৃণাল সেন চিঠিটাই বার-দুই পড়ে ভাঁজ করে নিজের পকেটেই রেখে দিল, চিঠিটা আমি রাখলাম মিঃ মুখার্জী!
বেশ।
মিঃ মুখার্জী-মিঃ রায় গত পরশু নিশ্চয় তার গাড়ি নিয়েই গিয়েছেন?
না।
গাড়ি নিয়ে যাননি?
না–ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কেন—ট্রেন কেন?