মাথাটা ও মুখটা একেবারে থেতলে গেছে। মানুষটাকে চিনবার উপায় নেই। তবে দামী জামা ও পায়ের দামী জুতো দেখে মনে হয় কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই হবে। বাঁ হাতে একটা দামী রিস্টওয়াচও দেখা গেল। কাচটা ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে।
মৃতদেহটাকে চিৎ করে ফেললেন জলধর চাটুজ্যে।
জামার পকেটগুলো খুঁজে দেখতে গিয়ে ভিতরের বুকপকেটে একটা দামী পার্স পাওয়া গেল।
পার্সের গায়ে সোনার জলে ইংরাজীতে এমবস্ করা—এম. এন. রায়। ভিতরে প্রায় হাজারখানেক টাকার নোট—একশ টাকা ও দশ টাকার নোটও আছে দেখা গেল।
আর একটা কার্ডও পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে। কার্ডে লেখা : এম. এন. রায়-রায় এন্ড কোং, ৯৩ ক্লাইভ রো, থার্ড ফ্লোর।
জলধর চাটুজ্যের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
যাক, তাহলে মৃত ব্যক্তির কিছুটা পরিচয় বা হদিস পাওয়া গেল, কি বলেন?
হুঁ। মৃদুকণ্ঠে জলধর চাটুজ্যে বলেন।
এবং শুধু তাই নয়-মৃত ব্যক্তি যে ধনী, অবস্থাপন্ন তাও জানা গেল তার পার্স থেকে। রসময় বলে।
গিরিধারীকে মৃতদেহের প্রহরায় রেখে জলধর চাটুজ্যে ফিরে এলেন। রসময়ও সঙ্গে সঙ্গে চলল।
কি মনে হচ্ছে চাটুজ্যে সাহেব? রসময় প্রশ্ন করে পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে, সুইসাইড, না মার্ডার?
বলা শক্ত।
তা ঠিক।
স্টেশনে পৌঁছে রসময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জলধর থানার দিকে হাঁটতে শুরু করেন।
দেখে-শুনে ব্যাপারটা মনে হচ্ছে সুইসাইড কেসই একটা। এবং লোকটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয়। পায়ের জুতো, মোজা ও পরিহিত সুটটা দেখে মনে হয় অবস্থাপন্ন ঘরেরই মানুষ।
অতএব অবিলম্বে লালবাজারে একটা সংবাদ দিতে হবে। মৃতদেহেরও একটা ব্যবস্থা। করতে হবে। তার মানেই নানা ঝামেলা।
থানায় ফিরে লালবাজারে ফোন করতেই স্বয়ং ডেপুটি কমিশনারই ফোন ধরলেন।
অবিনাশ চক্রবর্তী-চক্রবর্তী সব শুনে বললেন, আমি ইন্সপেক্টার মৃণাল সেনকে পাঠাচ্ছি।
অবিনাশ ফোন রেখে তখুনি মৃণাল সেনকে ডেকে পাঠালেন।
একটু পরে মৃণাল এসে ঘরে ঢুকল। অল্প বয়েস। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। পরিশ্রমী ও উৎসাহী।
আমাকে ডেকেছেন স্যার?
হ্যাঁ–তোমাকে এখুনি একবার আগরপাড়া যেতে হবে—সেখানকার থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যে একটু আগে ফোন করেছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। জলধরবাবুর ধারণা, ব্যাপারটা পিছনে কোন ফাউল প্লে আছে!
আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।
মৃণাল সেন স্যালুট দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
মৃণাল সেন আগরপাড়ায় যখন এসে পৌঁছল বেলা তখন প্রায় সোয়া নয়টা।
জলধরবাবুর মুখ থেকে মৃণাল সমস্ত ব্যাপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সর্বপ্রথম জেনে নিল। তারপর সে জলধরবাবুকে নিয়ে অকুস্থানে গেল।
ইতিমধ্যে সংবাদটা আশেপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
অনেকেই এসে ভিড় করেছিল আশেপাশে। কিন্তু গিরিধারীর জন্য কিছুটা দূরত্ব রেখে তারা জটলা পাকাচ্ছিল।
জলধরবাবু সকলকে তাড়া দিলেন।
তাড়া খেয়ে সবাই পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু স্থানত্যাগ করল না।
মৃণাল সেন মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল।
মৃতদেহ ও তার পরিধেয় বস্ত্র দেখে মনে হয় মৃত ব্যক্তি হয়ত চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লাইনের উপরেই এসে পড়ে, তার পর ইঞ্জিনের সামনে লোহার জালে আটকা পড়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। এবং শেষটায় হয়ত ধাক্কা খেয়ে পাশে ছিটকে পড়েছে।
কিম্বা হয়ত রেল লাইনের উপরেই সে শুয়েছিল আত্মহত্যা করবার জন্য—শেষটায় ঐ অবস্থা হয়েছে।
আত্মহত্যা করে থাকলে কোন প্রশ্ন নেই। এবং অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে থাকলেও লোকটা হয়ত চিৎকার করেছিল, সে চিৎকার হয়ত কেউ শুনতে পায়নি, এমন কি ইঞ্জিনড্রাইভারও শুনতে পায় নি। তা ছাড়া এ লাইন দিয়ে তো সাধারণত ট্রেন চলাচলও বড় একটা করে না।
কিম্বা হয়ত আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা কোনটাই নয়।কারণ ঠিক ঐখানে ঐভাবে এসে আত্মহত্যা করা বা দুর্ঘটনা ঘটা কোনটাই সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে না।
হয়ত ব্যাপারটা একটা মার্ডার কেস।
চলুন ফেরা যাক মিঃ চ্যাটার্জী-মৃণাল সেন বলে, মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর একটা খোঁজ নেবেন তো
কি বলুন তো!
রূপশ্রী কটন মিলে খোঁজ নেবেন, গতকাল কোন ওয়াগন লোডিং হয়েছে কিনা–
নেবো।
হ্যাঁ—আরও একটা খোঁজ নেবেন।
কি?
এ তল্লাটে এম. এন. রায় বলে কেউ আছেন কিনা—যদি থাকেন তার যথাসম্ভব পরিচয়।
বেশ।
পার্সটা যেটা মৃত ব্যক্তির জামার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সেটা নিয়ে মৃণাল ফিরে এল।
.
পরের দিন—যেটুকু সূত্র হাতের মধ্যে আপাতত পাওয়া গিয়েছিল তার সাহায্যেই মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে মৃণাল সেন।
ক্লাইভ রো—বেশি দূর নয়, লালবাজারের কাছেই।
প্রথমেই মৃণাল ক্লাইভ রোতে রায় এন্ড কোম্পানির অফিসে গিয়ে হাজির হল! একটা বিরাট পাঁচতলা বিল্ডিং ৯৩ নং ক্লাইভ রোতে।
তিনতলায় রায় এন্ড কোম্পানির অফিস।
বিরাট অফিস-দেখেই বোঝা যায়—বিরাট বিজনেস।
আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিল মৃণাল সেন-প্রধানত কয়লার খনি, ঐ সঙ্গে নানাজাতীয় কেমিকেলস-এরও ব্যবসা করে রায় এন্ড কোম্পানি।
এনকোয়ারিতে গিয়ে সন্ধান নিয়ে মৃণাল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ দিল বিশেষ জরুরী বলে।
.
০৩.
একটু পরেই অফিস ম্যানেজার মিঃ মুখার্জীর ঘর থেকে মৃণালের ডাক এল।