কুন্তলা আমার এখানে! কই না তো। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো?
সন্ধ্যার মুখে একটা গাড়ি আসে তোমার একটা চিঠি নিয়ে—কুন্তলার নামে।
কুন্তলার নামে চিঠি! কি বলছ তুমি সুরেন?
হ্যাঁ, আর সেই চিঠি পেয়েই তো কুন্তলা চলে গিয়ছে। এত রাত হচ্ছে, ফিরছে না দেখে তোমার বাড়িতে ফোন করে জানলাম তুমি এখানে!
কিরীটী সুব্রতর কথা বলা শুনেই বুঝেছিল কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। তাড়াতাড়ি সে সুব্রতর পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে, কি বলছে সুরেন?
বুঝলাম না ঠিক—
মনে হল যেন তোকে কুন্তলার কথা কি জিজ্ঞাসা করছিল?
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করছিল কুন্তলা আমার এখানে এসেছে কিনা। কে বলে একটা চিঠি নিয়ে–
চিঠি! কীসের চিঠি? কার চিঠি?
সুব্রত সংক্ষেপে তখন সব কথা খুলে বলে কিরীটীকে।
কিরীটী সব শুনে বলে, এইরকম একটা কিছু তোর কথা শুনে আমি অনুমান করেছিলাম। তুই এখুনি মৃণাল সেনকে ফোন কর, কয়েকজন আর্মড পুলিস নিয়ে যেন সে প্রস্তুত থাকে। আমরা এখুনি আসছি।
সুব্রত কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি থানায় মৃণাল সেনকে ফোন করে দিল।
কিরীটী আর একটা মুহূর্তও দেরি করে না, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নেয়।
চল শিগগির—
গাড়ি লালবাজারের দিকে ছুটে চলেছে।
সুব্রতই গাড়ি চালাছিল। কিরীটী পাশে বসে।
কিরীটী বলছিল, খুনী কে-তাকে তুই তো অনেক আগেই ধরতে পারতিস যদি একবার ভাল করে ভেবে দেখতিস, ডাঃ চৌধুরীর যে উইলের কথাটা তোকে বলছিলাম –সেই উইলের কথাটা–
ডাঃ চৌধুরীর উইল।
হ্যাঁ। মনে করে দেখ, সে উইলে কি লেখা আছে এবং উইলের কথা কে কে জানত?
কিন্তু–
ঐখানেই তুই আলো দেখতে পেতিস বর্তমান রহস্যের!
আমি গতকালই সে উইলের কথা জানতে পেরেছি, কারণ তাঁর সেই উকিল বন্ধু, যিনি উইল তৈরি করেছিলেন তার মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে, তিনি কলকাতায় ছিলেন না। তারপরই তো তোকে জানাই।
ঐ উইলই হচ্ছে কাল।
কিন্তু সে উইলে কি আছে?
এখন সে কথা থাক। লালবাজার পৌঁছে গেছি আমরা। সর্বাগ্রে তোর কুন্তলা উদ্ধার, তারপর অন্য কথা।
.
মৃণাল সেন ফোনে নির্দেশ পেয়েই প্রস্তুত হয়ে ছিল।
কিরীটী বলে, মিঃ সেন, আপনি আমাদের গাড়িতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, পুলিশ ভ্যান আমাদের ফলো করবে।
মৃণাল সেন সুব্রতর গাড়িতে উঠে পড়ে।
সুব্রত এবার শুধায়, কোথায় যাব?
শ্রীরামপুর।
শ্রীরামপুরে!
সুব্রত কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, খুব জোরে চালা।
সুব্রত গাড়ি ছেড়ে দেয়।
.
ধীরে ধীরে কুন্তলার জ্ঞান ফিরে এল একসময়।
নিঃশঙ্ক চিত্তেই গাড়িতে এসে উঠে বসেছিল কুন্তলা।
সুব্রতর হাতের লেখা সে কখনও দেখেনি ইতিপূর্বে এবং চিনতও না। তাই সুব্রতরই লেখা ভেবে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে সে এসে গাড়িতে উঠে বসেছিল চিঠিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।
একবারও তার কথাটা মনে হয়নি, সুব্রতর তো বাড়িতেই ফোন ছিল! সুব্রত তাকে ফোন করে জানাতে পারত কথাটা!
আর তেমন যদি প্রয়োজন হবে তো সুব্রত চিঠি দিয়ে পাঠাবে কেন? সে নিজেও তো আসতে পারত ওর ওখানে?
আর সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু অতি বড় বিচক্ষণ ব্যক্তিও মাঝে মাঝে এমন হাস্যকর ভুল করে ঘটনাচক্রে। কুন্তলাকেও বোধ হয় তাই তেমন দোষ দেওয়া যায় না।
পরে সুব্রত যখন কুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি এত বড় ভুল করেছিলে কি করে কুন্তলা?
কি জানি কেন—বোধ হয়–
কি?
তুমি ডেকেছ তাই কোন কিছুই আর মনে হয়নি সে-সময়।
কিন্তু আমরা যদি আর একটু দেরি করতাম বা কোন কারণে দেরি হত।
কি আর হত!
কিছু হত না বুঝি?
না।
সত্যি-সত্যি বলছ?
কুন্তলা মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল অতঃপর।
.
২০.
কুন্তলা জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখল একটা ঘরে শয্যার উপর শুয়ে আছে।
কেমন করে কীভাবে সে এখানে এল কিছুই যেন প্রথমটায় মনে পড়ে না।
প্রথমটায় সব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে—কিছুই চিন্তা করতে পারে না।
তারপর মনে পড়ে, গাড়ির মধ্যে যে দ্বিতীয় ব্যক্তি অন্ধকারে বসেছিল এবং যাকে সে দেখতে পায়নি তাড়াহুড়ায়, সে যেন তাকে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে অকস্মাৎ জাপটে ধরে তার নাকের ও মুখের ওপরে কি একটা চেপে ধরেছিল-সঙ্গে সঙ্গে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুন্তলার।
একটা উগ্র মিষ্টি গন্ধে সব যেন সঙ্গে সঙ্গে কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল। তলিয়ে গিয়েছিল ও, হারিয়ে গিয়েছিল ও-চেতনা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
অনেক-অনেক দূর থেকে যেন ঝাপসা অস্পষ্ট কার গলা শোনা যায়।
কে যেন কাকে বলছে, কি হল ঠাকুরমশাই, তাড়াতাড়ি করুন! ভামিনী, এই ভামিনী–
কি?
দেখ জ্ঞান ফিরল কিনা!
দরজা খোলার শব্দ।
চোখ মেলে তাকায় কুন্তলা। ঘরের মধ্যে স্বল্পশক্তির একটা আলো জ্বলছে। আলোটা তবু যেন চোখে লাগে ওর।
কে এসে যেন পাশে দাঁড়াল।
দিদিমণি-অ দিদিমণি?
কর্কশ মেয়েলী গলায় কে যেন ডাকে কুন্তলাকে।
উঁ!
কি গো, ঘুম ভাঙল?
পূর্বের সেই কর্কশ নারী-কণ্ঠস্বর।
আমি কোথায়? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে কুন্তলা।
কোনমতে আস্তে আস্তে শয্যার উপরে উঠে বসে কুন্তলা। মাথাটা যেন তখন ঝিমঝিম করছে!
এই যে জ্ঞান ফিরেছে!
কে?
কেন, চিনতে পারছ না?
নীরেনবাবু?
হ্যাঁ। যাক, চিনেছ তাহলে!
আমি কোথায়?
আমার বাড়িতে।
আপনার বাড়ি।
হ্যাঁ।
এর মানে কি নীরেনবাবু?
মানে তো অত্যন্ত সহজ।
নীরেনবাবু।