হ্যাঁ।
আমার তো ভয়ই হয়েছিল, এখুনি বুঝি দারোয়ান ডেকে বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেবে।
কুন্তলা চুপ করে থাকে।
কিন্তু এখন আর রাগটা নেই তো?
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না।
সে রাত্রে কুন্তলাকে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল সুব্রত।
.
১৯.
অপঘাতে মৃত্যু হলেও নিয়মমাফিক মহেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে গেল।
কুন্তলাই শ্রাদ্ধ করল।
সুব্রত সেদিন গিয়েছিল কুন্তলার নিমন্ত্রণে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে।
তারপর আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। মহেন্দ্রনাথের হত্যার ব্যাপারটা যেন। কেমন চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে আরও দুদিন সুব্রত কুন্তলাদের ওখানে গিয়েছিল। কুন্তলার সঙ্গে বসে বসে গল্প করেছে।
বেরিলিতে ভবেন্দ্রর কোর্ট অফ এনকোয়ারি চলছে—শেষ হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যায় কুন্তলা তার শোবার ঘরে বসে একটা উলের বুননি নিয়ে আত্মমগ্ন ছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে দাঁড়িয়ে সামনেই তার নীরেন।
কুন্তলা!
তুমি!
হ্যাঁ। নীরেন ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
কুন্তলা, আমি কিন্তু আজ একটা বিশেষ কথা জানাবার জন্যই এসেছি।
কুন্তলা তাকাল নীরেনের মুখের দিকে।
বুঝতে পারছ বোধ হয়, যে ব্যাপারে তোমাকে দুদিন আগে একটা চিঠি দিয়েছি–এবং সে চিঠিটার জবাব তুমি এখনও দাওনি–
কুন্তলা তথাপি চুপ করেই থাকে, হাতের বুননটা নিয়েই যেন সে ব্যস্ত।
চিঠিটা তুমি আমার পেয়েছ নিশ্চয়ই?
পেয়েছি।
জবাব দাওনি!
না। তারপই একটু থেমে কুন্তলা বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
ক্ষমা করব–কীসের জন্যে? কি ব্যাপার বল তো?..
কুন্তলা নীরেনের মুখের দিকে তাকাল, চোখ তুলে বললে, আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
সম্ভব নয়?
নীরেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না। শান্ত গলায় আবার জবাব দেয় কুন্তলা।
তা হঠাৎ এই মতের পরিবর্তন?
নীরেনের গলার স্বরটা যেন বেশ একটু কঠিন মনে হয়।
পরিবর্তন!
আছাড়া আর কি! এতদিন তো মতই ছিল—হঠাৎ সুব্রতবাবুর আবির্ভাবে—
নীরনবাবু!
তুমি মনে কর কুন্তলা দেবী, একমাত্র এ দুনিয়ায় তুমিই চালাক আর আমরা বোকা–ঘাস খাই! সুব্রতবাবুর সঙ্গে যে ঢলাঢলি শুরু হয়েছে ইদানীং–
নীরেনবাবু, ভদ্রভাবে একজন ভদ্রলোকের সম্পর্কে কথা বললেই আমি খুশি হব।
ভদ্রলোক—তাই না! হঠাৎ ফাঁকতালে বাপের সম্পত্তি পেয়ে মাথাটা বিগড়ে গিয়েছে!
নীরেনবাবু!
চোখ রাঙাচ্ছ কাকে কুন্তলা দেবী?
যান-যান এখান থেকে বলছি—
কুন্তলা তখন উঠে দাঁড়িয়েছে, তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।
যাচ্ছি। তবে মনে রেখো কুন্তলা দেবী, এত সহজে নীরেন সান্যাল অপমানকে হজম করে নেয় না।
বের হয়ে যান—বের হয়ে যান এ ঘর থেকে! হঠাৎ যেন সব কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠে কুন্তলা।
চিয়ারিও মাই হনি বাঞ্চ! আই অ্যাম গোয়িং নাউ, বাট ইউ উইল হিয়ার মি এগেন-হেয়েন আই ওয়ান্ট ইউ। আপাতত বিদায়–
নীরেন সেন কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করে।
কুন্তলা!
কুন্তলা দুহাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল, সুব্রতর ডাকে যেন ভেঙে পড়ে। চেয়ারটার উপরে বসে পড়ে। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
সুব্রত কুন্তলার মাথায় একটা হাত রাখে, কি হয়েছে কুন্তলা?
কুন্তলা জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে।
.
ঐ দিনই রাত্রে।
কিরীটীর বাড়িতে-সুব্রত আর কিরীটী কথা বলছিল।
আসলে কিরীটীই বলছিল, সুব্রত শুনছিল।
তাহলে তুমি বলছ মিঃ গাঙ্গুলীকেও হত্যা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, সুব্রত। তাকেও একই হত্যাকারী, যে মহেন্দ্রনাথকে হত্যা করেছিল, সেই-ই হত্যা করেছে। তারপর যেমন মহেন্দ্রনাথের ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট বা সুইসাইড বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিল, এক্ষেত্রেও মিঃ গাঙ্গুলীর হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারটা গুজে দিয়ে সেই চেষ্টাই করেছে খুনী।
কিন্তু কেন-গাঙ্গুলীকে হত্যা করল কেন সে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
ঠিক একই কারণে। অর্থাৎ যে কারণে মহেন্দ্রনাথকে সে হত্যা করেছে।
কি-কি সে কারণ?
এখনও বুঝতে পারনি!
না।
ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ঐ চিঠি।
মানে সেই সাংকেতিক চিঠি!
হ্যাঁ, সেই চিঠিই হল কাল। চিঠিই ডেকে এনেছে নৃশংস মৃত্যু।
কিন্তু কি করে, তবে কি–
তাই-এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সম্ভবত মহেন্দ্রনাথ চিঠির সাংকেতিক পাঠ প্রথম উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রথম আঘাত হানে হত্যাকারী। তারপর মিঃ গাঙ্গুলী—তিনিও হয়ত শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুর ঐ সাংকেতিক চিঠির রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন, আর সে-কথা হত্যাকারী জানতে পারায় সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের মতই পথের কাঁটা হিসাবে পথ থেকে তাকেও সরিয়ে দিতে দেরি করেনি। তাকেও পৃথিবী থেকে যেতে হল।
তাহলে তুই নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিস—
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে এবং–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—ঘরের ফোনটা হঠাৎ ঐ সময় ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কিরীটীই এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তোলে, কে—আছে হ্যাঁ ধরুন। সুব্রত তোর ফোন–
কে?
তোর হবু খুড়শ্বশুর সুরেন্দ্রনাথ।
সুরেন।
হ্যাঁ, দেখ, বোধ হয় জামাইকে নিমন্ত্রণ জানাতে চায়!
কিরীটীর ঠাট্টায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে, কি খবর সুরেন?
কুন্তলা কি তোমার ওখানে গিয়েছে?