কেবল মৃদুকণ্ঠে কুন্তলাকে অনুরোধ জানায়, কুন্তলা দেবী, আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে ফুলে ফুলে।
প্লীজ বলুন।
ধীরে ধীরে কুন্তলা এবার মুখ তুলল।
তার চিবুক ও গণ্ড অশ্রুতে প্লাবিত। দুচোখের কোণে তখনও টলমল করে অশ্রু।
সুব্রতবাবু!
বলুন।
ছোড়দা–ছোড়দা সেদিন আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিল।
আমি তা জানি কুন্তলা দেবী। শান্তকণ্ঠে সুব্রত জবাব দেয়।
জানেন?
জানি বৈকি। আর এও জানি গত ২৩শে ডিসেম্বর আপনার ভাই সমস্ত দিন সিঁথিতে তার যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন সেখানে ছিলেন না—এবং তিনি যে আমাকে বলেছিলেন সে-রাত্রে ঐ সময় সিনেমাতে গিয়েছিলেন তাও মিথ্যা।
মিথ্যা!
হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছিলেন তিনি। এবং যতক্ষণ না তিনি বলছেন ২৩শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন ততক্ষণ তার উপর থেকে পুলিসের সন্দেহটা কিছুতেই যাবে না। বিশেষ করে যখন জানা গিয়েছে তারই রিভলবারে আপনার বাবা ও মিঃ গাঙ্গুলী উভয়েরই মৃত্যু হয়েছে।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টার আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন, তিনিও তা বলে এলেন। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি সুব্রতবাবু, ছোড়দার চরিত্রে যত দোষই থাক, সে জুয়া খেলে, বেহিসাবী, অসংযমী—কিন্তু সে বাবাকে হত্যা করেনি। তার মনটা এত সফ্ট, এত কোমল–
কিন্তু পুলিস তো মনের খবর নিয়ে কাজ করে না কুন্তলা দেবী, আর করবেও না। তারা ফ্যাক্ট নিয়ে সব বিচার করে।
সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ছোড়দা কোথায় ছিল জানি না। কিন্তু—
কি বলুন, থামলেন কেন?
বোধ করি তখন সাড়ে এগারোটা হবে, ছোড়দা আমার কাছে এসেছিল সে রাত্রে গড়িয়াহাটার বাড়িতে—সে সময় পরনে ছিল তার মিলিটারি ইউনিফর্ম! মাথার চুল এলোমেলো। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। কেমন যেন অস্বাভাবিক চেহারা।
তারপর?
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথা থেকে আসছে সে? এত রাত্রে বেরিলি থেকে নাকি?
আচ্ছা, সদর দিয়ে সে-রাত্রে বাড়িতে ঢুকেছিল কি?
না, পিছনের পাঁচিল টপকে।
তারপর?
সে বলল, না, বেরিলি থেকে সে আট-দশদিন হল এসেছে। ছুটি নিয়ে এসেছে।
বলেছিল ছুটি নিয়ে এসেছে?
হ্যাঁ, বলেছিল। আরও বলেছিল চাকরি করতে আর ভাল লাগছে না।
তারপর?
আমি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন বাড়িতে ওঠেনি? তাতে বলেছিল—
কি?
বাড়িতে আর সে কোন দিনও আসবে না। বাবা নাকি তাকে বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আপনি চলে আসবার পর বললে, সে আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল। ছুটি নিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছে।
আর—আর কিছু আপনার ছোড়দা আপনাকে বলেনি?
না।
কিন্তু আমি জানি—
কি?
কিছু সে আমার কাছে গোপন করেছে। কিন্তু যাই সে গোপন করে থাকুক না কেন, বাবাকে সে হত্যা করেনি আপনি বিশ্বাস করুন সুব্রতবাবু।
সুব্রত চুপ করে কি যেন ভাবে।
কুন্তলা আবার বলে, ছোড়দাকে আপনি বাঁচান সুব্রতবাবু!
আপনি অধীর হবেন না, শান্ত হোন।
কিন্তু আগে আপনি বলুন, ছোড়দাকে আপনি বাঁচাবেন?
ঢং করে রাত্রি সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল ঐ সময়।
রাত অনেক হয়েছে—চলুন, উঠুন-বাড়ি যান এবার। সুব্রত বলে।
কুন্তলা উঠে দাঁড়ায়। কীসে এসেছেন? সুব্রত শুধায়।
ট্যাক্শিতে।
ছি ছি, এত রাত্রে এই যুদ্ধের সময় একা একা ট্যাকশিতে এসেছেন! খুব অন্যায় করেছেন—চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
না, না—আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট নয়—আপনাকে এত রাত্রে একা একা আমি ছেড়ে দিতে পারি না। সুরেনের ভাইঝি আপনি, তাছাড়া এসময় এত রাত্রে ট্যাকশিও আপনি পাবেন না।
সুব্রত অতঃপর জামাটা গায়ে দিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বললে, চলুন—
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে গাড়ির দরজা খুলে সুব্রত কুন্তলাকে ডাকে, আসুন উঠুন।
কুন্তলা গাড়িতে উঠে বসল।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ হলেও শহরে তখনও বেশ শীত। শীতের আকাশ—কিন্তু কুয়াশার লেশমাত্রও ছিল না, কৃষ্ণা-চতুর্দশীর চাদ আকাশে। ম্লান চাঁদের আলোয় যেন প্রকৃতি মূৰ্ছাতুরা। খাঁ খাঁ করছে রাস্তা।
সুব্রতর গাড়ি হ্যারিসন রোড দিয়ে শিয়ালদহ হয়ে সার্কুলার রোডে পড়ে। পাশেই একেবারে গা ঘেঁষে কুন্তলা। গাড়ির খোলা জানালাপথে হাওয়ায় কুন্তলার চুল উড়ছে। মৃদু একটা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ নাকে আসে।
এ পথ যদি না ফুরাত! সুব্রতর মনে হয়, যদি অন্তহীন এ পথ হত! আর এমনি করে কুন্তলা তার পাশে থাকত।
ছি, এসব কি ভাবছে সে! মাথা তার খারাপ হয়ে গেল নাকি!
কুন্তলা দেবী!
বলুন?
আপনি কিন্তু খুব অন্যায় করেছেন।
অন্যায় করেছি! কুন্তলা ফিরে তাকায় পার্শ্বে উপবিষ্ট সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, করেছেন! কতটুকু বা আমার সঙ্গে আপনার পরিচয়, বলুন তো? হুট করে। এত রাত্রে আমার ওখানে চলে এসেছেন–
আমি জানতাম।
কি?
আপনার কাছে যেতে কারোরই কোন ভয়ের কারণ থাকতে পারে না।
জানতেন?
হুঁ।
কি করে জানলেন?
পুরুষকে চিনতে কোন মেয়েরই ভুল হয় না। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
অনুরোধ!
হ্যাঁ, কাকামণির বন্ধু আপনি-আমাকে আপনি বলবেন না আর—
কিন্তু—
‘তুমি’ বলবেন।
বেশ। একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, একটা কথা বলব?
কি?
সেদিন অমন করে হঠাৎ রাত্রে তোমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম বলে তুমি আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিলে, না?