চলন্ত গাড়িতে বসেই একসময় মৃণাল সেনকে সুব্রত প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার? চ্যাটার্জী। ফোনে আপনাকে কি বলেছেন?
সুব্রত প্রশ্নটা করে মৃণাল সেনের মুখের দিকে তাকাল।
মৃণাল সেনকে ফোনে যা জানিয়েছিলেন জলধর চাটুজ্যে–সংক্ষেপে সুব্রতকে সব কথা জানায় সে।
.
১৭.
সন্ধ্যা থেকে আগরপাড়াতেও জলঝড় শুরু হয়।
বিকালের দিকে একবার গাঙ্গুলীর পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন, বোধ হয় কফি পান। করতে এবং জলঝড়ের সম্ভাবনা দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন সলিটারিী কর্নারে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তার পরই ঝড়-বৃষ্টি শুরু।
রাজেশ বলে যে ছেলেটি ওয়াচ করছিল বাড়িটা-ঝড়বৃষ্টির জন্য তাড়াতাড়ি গিয়ে পান্থনিবাসে আশ্রয় নেয়। ঘণ্টা দুই পরে ঝড়বৃষ্টি একটু কমে। তখন সে আবার পান্থনিবাস থেকে বের হয়ে সলিটারি কর্নারের দিকে যায়।
বৃষ্টি তখন টিপ টিপ পড়ছে। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখে বাড়িটা অন্ধকার।
প্রথমে রাজেশ ভেবেছিল, ঝড়-বৃষ্টির জন্যে বোধ হয় তাড়াতাড়ি মিঃ গাঙ্গুলী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ নজরে পড়ে, বাড়ির সদর দরজাটা হা-হা করছে খোলা। হাওয়ায় খুলছে আর শব্দ করে বন্ধ হচ্ছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং রাজেশকে যেন কেমন সন্দিগ্ধ করে তোলে।
সে এগিয়ে যায় খোলা দরজা দিয়ে, ভিতরে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকবার পর সেখানেও দেখে অন্ধকার। কারও কোন সাড়া-শব্দ নেই—যেন একটা পরিত্যক্ত হানাবাড়ি।
অবশেষে রাজেশ টর্চের আলোর সাহায্যে মিঃ গাঙ্গুলীর ঘরে গিয়ে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ায়।
ঘরের এক কোণে একটা রাইটিং টেবিল। তার সামনে চেয়ারে বসে গাঙ্গুলী, তাঁর মাথাটা টেবিলের উপরে ন্যস্ত। বাঁ হাতটা টেবিলের উপরে বিস্তৃত এবং ডান হাতটা অসহায়ের মত ঝুলছে। সেই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা একটা রিভলবার।
টেবিলের কাচের উপরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। সোফাতেও কিছু গড়িয়ে পড়েছে। কপালের মাঝামাঝি একটা বেশ বড় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।
ঘরের সব জানালাগুলো বন্ধ। পিছনের বাগানের দিককার জানালাটা খোলা। আর ঘরের দরজাটাও খোলা।
সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, মিঃ গাঙ্গুলীর চাকরটা কোথায় ছিল ঐ সময়? সে তখন ছিল না।
ছিল না মানে?
বাইরে গিয়েছিল এবং একটু পরেই ফিরে আসে। সে নাকি দুপুরের দিকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় তার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
তাহলে বাড়িতে কেউ ছিল না ঐ সময়ে একমাত্র মিঃ গাঙ্গুলী ছাড়া?
না।
তারপরই একটু হেসে মৃণাল সেন বলে, তখন যদি মিঃ গাঙ্গুলীকে আপনি অ্যারেস্ট করতে দিতেন সুব্রতবাবু, তবে হয়ত এভাবে মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের ফাকি দিতে পারতেন না। ধরা পড়বার ভয়েই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করলেন হয়ত ভদ্রলোক।
মিঃ সেন—সুব্রত বলে, মহেন্দ্রনাথের হত্যাকারী উনি নন।
এখনও আপনি তাই বলছেন?
হ্যাঁ।
তবে কে?
আর যেই হোক, আপাতত বলতে পারি মিঃ গাঙ্গুলী নন।
মৃণাল সেন অতঃপর চুপ করে থাকে।
.
ওরা যখন আগরপাড়া থানায় এসে পৌঁছল রাত তখন সোয়া একটা।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
তবে হাওয়া একেবারে থামেনি। হাওয়া চলেছে।
জলধর চাটুজ্যে ছিলেন না, থানার ছোটবাবু সুশীল সোম ছিলেন।
তিনি বললেন, স্যার, আপনাদের বড়বাবু সোজা সলিটারি কর্নারে চলে যেতে বলেছেন।
ওরা তখনই আবার সলিটারি কর্নারের দিকে গাড়ি ছোটায়।
ওরা যখন সলিটারি কর্নারে গিয়ে পৌঁছল, জলধর চাটুজ্যে নানাভাবে তখনও মিঃ গাঙ্গুলীর ভৃত্যকে ক্রস করছিলেন।
লোকটা জবাব দিচ্ছে আর কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছছে।
মৃণাল সেনকে দেখতে পেয়ে জলধর চাটুজ্যে বলেন, এ নিশ্চয় আমার মনে হয় মিথ্যে বলছে, সেন সাহেব। ও ঝড়জলের আগেই ফিরে এসেছে।
সুব্রত একবার লোকটার দিকে তাকিয়ে যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল।
.
সত্যিই করুণ দৃশ্য।
টেবিলের সামনেই নিচে মেঝেতে একটা বই পড়ে আছে। একটা নামকরা ইংরেজী উপন্যাস। সেই উপন্যাসের মলাটের উপরেও কয়েকটা রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধে আছে।
মৃণাল সেন বলে, মনে হচ্ছে ও ক্লিয়ার কেস অফ সুইসাইড। বোধ হয় পড়তে পড়তে এসময় ডিসিশন নেন, তারপরই রিভলবারটা বের করে নিজের মাথায় গুলি করেছেন।
সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে, একটু যেন অস্বাভাবিক মনে হয় ব্যাপারটা মিঃ সেন!
কি?
পড়তে পড়তে হঠাৎ সুইসাইড করা। তাছাড়া সে রকম হলে বইটা মাটিতে না পড়ে হয়ত টেবিলের উপরেই থাকত!
তারপই হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বলে, সারা ঘরময় এত পোড়া কাগজ কেন বলুন তো?
সত্যিই তো ঘরময় পোড়া কাগজ!
সুব্রত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেল, ঘরের কোণে কি যেন পোড়ানো হয়েছে। তার সুস্পষ্ট চিহ্নও রয়েছে।
এগিয়ে গেল সুব্রত সেদিকে।
কিছু আধপোড়া কাগজও তখনও সেখানে পড়ে আছে।
কৌতূহলভরে সুব্রত আধপোড়া কাগজগুলো তুলে নিল।
বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ল কতকগুলো অঙ্ক, সেই পোড়া কাগজের বুকে-১৫, ২১, ২০, ১৩ ইত্যাদি।
হঠাৎ মনে পড়ে সুব্রতর। অঙ্কগুলো তার পরিচিত।
ভাবতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই চিঠি দুটোর কথা। ডাঃ চৌধুরীর লেখা দুই বন্ধুকে দুখানা চিঠি।
কিরীটী বলেছিল সেদিন একটা কথা, একেবারে অর্থহীন নয়—কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন মনে হয়!