কলিংবেল আর একবার কিন্তু বাজাতে হল না। বেয়ারা দরজা খুলে দিল।
ছোটবাবু-ভবেন্দ্রবাবু বাড়িতে আছেন?
না তো!
কখন বের হলেন?
প্রায় ঘণ্টা দুই হবে।
আশ্চর্য, আমাকে এ সময় আসতে বলেছিলেন!
আসতে বলেছিলেন!
হ্যাঁ, বোধ হয় এসে যাবেন এখুনি। আমি বরং একটু বসি। সুব্রত বলে।
ভৃত্য কোন কথা বলে না।
দিদিমণি আছে?
হ্যাঁ।
কি করছেন? দিদিমণির শরীরটা সকাল থেকে খারাপ—শুয়ে আছেন।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও, আমি বসছি।
বেয়ারা আর কথা বলল না। সুব্রত তার অপরিচিত নয়।
দু-চারদিন এখানে এসেছে—একজন পুলিস অফিসারও প্রথমবার সঙ্গে ছিল। সেদিন তো দিদিমণির সঙ্গে অনেকক্ষণ বসে কথাও বলে গেল।
বেয়ারার মনে কোন সন্দেহ জাগে না।
.
১৫.
বেয়ারা চলে গেল।
তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে সুব্রত উঠে দাঁড়াল।
দোতলায় একটি ঘরেই মাত্র আলো জ্বলতে দেখেছে সুব্রত গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকবার সময়। নিশ্চয়ই ঐ ঘরটাই কুন্তলার। দক্ষিণ দিকের ঘরটা।
পা টিপে টিপে সুব্রত ড্রইংরুম থেকে বেরুল।
একটা হলঘর। এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। হলঘরটা অন্ধকার। সিঁড়িতে একটা আলো জ্বলছে স্বল্পশক্তির। চওড়া চওড়া সিঁড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে।
সুব্রত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়!
দোতলার বারান্দা। টানা বারান্দা। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে বারান্দায়। আলোছায়ার একটা রহস্য যেন।
দক্ষিণদিককার ঘরটায় আলো জ্বলছিল—দেখেছে সুব্রত। সেই দিকেই পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।
কাচের শার্সি দিয়ে ঘরের ভিতরকার আলোর আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু জানালায় পর্দা থাকায় ভিতরের কিছু নজরে পড়ে না।
দরজা-দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুব্রত। মৃদু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাল সুব্রত। কুন্তলা পিছন ফিরে দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
আর একটা টেবিলে প্লেটে খাবার—কে একজন টুলের উপরে বসে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে।
লোকটার বয়স বেশি হবে না। সাতাশ-আটাশ বলেই মনে হয়। পরনে একটা পায়জামা ও পাঞ্জাবি, তার উপরে একটা আলোয়ান জড়ানো। একমুখ দাড়ি।
খেতে খেতে একসময় লোকটা বলে, না এমন করে পারছি না কুন্তী।
ইউনিটে তুমি ফিরে যাচ্ছ না কেন?
উপায় নেই। উপায় থাকলে কি যেতাম না!
কিন্তু এভাবে পালিয়ে পালিয়েই বা কতদিন বেড়াবে?
কুন্তলা দেবী!
কে?
চমকে দুজনেই ফিরে তাকায়। যুগপৎ কুন্তলা ও ভবেন্দ্র।
ভবেন্দ্র ততক্ষণে উঠ দাঁড়িয়েছে।
হু-হু ইজ হি? ভবেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করে বোনকে।
এ কি আপনি-আপনি উপরে এ ঘরে। কুন্তলার স্বরে বিরক্তিটা যেন বেশ স্পষ্টই।
আই অ্যাম ভেরি সরি, অত্যন্ত দুঃখিত মিস রায়। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।
উপায় ছিল না মানে? আপনি না বলে কয়ে—
বললাম তো, অত্যন্ত দুঃখিত-ক্ষমা চাইছি।
ভবেন্দ্র আবার প্রশ্ন করে, বাট হু ইজ দিস জেনটেলম্যান, কুন্তী?
সুব্রত বলে, তাছাড়া আপনি হয়ত জানেন না, ফোনে ওঁর এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আমি এখানে এসেছি!
ফোনে সংবাদ পেয়েছেন?
হ্যাঁ। যারা সর্বক্ষণ এ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে তারাই আমাকে ও ইন্সপেক্টার মিঃ সেনকে সংবাদটা দিয়েছে—উনি এখানে এসেছেন।
হঠাৎ কুন্তলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
মুখের উপরে ক্ষণপূর্বে যে বিরক্তির মেঘটা দেখা দিয়েছিল, তার যেন অবশিষ্ট মাত্রও থাকে না। বরং একটা ভয় একটা উদ্বেগের ছায়া যেন মুখের উপরে ভেসে উঠেছে।
সুব্রত ভবেন্দ্রকে দেখিয়ে বলে, উনি আর এখন পুলিশের অজান্তে এখান থেকে বেরুতে পারবেন না মিস রায়!
কিন্তু কেন—কেন পুলিস ওর গতিবিধির উপরে নজর রেখেছে? একটা চাপা আর্তনাদের মতই যেন প্রশ্নটা কুন্তলার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে।
সেটা আপনার ছোড়দাকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিস রায়! সুব্রত শান্ত কণ্ঠে বলে।
ভবেন্দ্র একেবারে চুপ।
সে তখনও ঠিক ব্যাপারটা যেন বুঝে উঠতে পারছে না—কে লোকটা। পুলিসের কোন লোক বলে তো মনে হচ্ছে না। সোজা একেবারে বিনা এত্তেলায় অন্দরে চলে এসেছে এবং তার বোনের সঙ্গে যে ভাবে কথা বলছে তাতে করে মনে হচ্ছে পরস্পরের। সঙ্গে ওদের পরিচয়ও আছে।
সুব্রত আবার বলে, তাহলে সেদিন আপনি আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেননি মিসেস রায়!
সত্যি কথা বলিনি! কুন্তলা প্রশ্নটা করে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
তাই নয় কি! আপনি জানতেন আপনার ছোড়দা কলকাতাতেই আছেন!
কুন্তলা একেবারে যেন চুপ এবারে। সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, কি, জানতেন না মিস রায়?
কুন্তলা মাথা নিচু করে।
এবার সুব্রত ভবেন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি নিশ্চয় জানেন ভবেন্দ্রবাবু, আপনি আর্মির আইনে একজন ডেজার্টার এবং ডেজার্টারদের মিলিটারি আইনে কোর্টমার্সাল হয়।
ভবেন্দ্ৰ যেন পাথর।
তাছাড়া আপনার মাথায় তো একটা কোর্ট মার্সাল ঝুলছে আপনার রিভলভারটা হারানোর জন্য!
রিভলভার? হঠাৎ কুন্তলা চমকে ওঠে।
হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করুন না আপনার ভাইকে! সুব্রত বলে।
ছোড়দা—
কুন্তলার কথা শেষ হল না—ভবেন্দ্র বললে, হ্যাঁ, হারিয়েছে।
কোথায় হারালো—কি করে হারালো?
কুন্তলা যেন কতকটা চাপা আর্তনাদের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করে।
জানি না—আমি কিছু জানি না। ভবেন্দ্র হঠাৎ বলে ওঠে, তারপর সুব্রতর দিকে তাকায়, চলুন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি, চলুন।
ছোড়দা?
কুন্তলা চেঁচিয়ে ডাকে আর্ত গলায়।