আপনি তো করেছিলেন! খবর এসেছে কিছু?
হ্যাঁ। একটু আগে আই. জির কাছে ১৪তম আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে সংবাদ এসেছে ওদের দুজনেরই সম্পর্কে। সেই সংবাদ জানতে পেরেই আপনাকে বলতে এসেছি।
বলুন!
হেড কোয়ার্টার জানাচ্ছে, ক্যাপ্টেন সৌরীন্দ্র রায় বর্তমান পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে আজ প্রায় দুমাস হল আরাকান ফ্রন্টেই আছেন। ইতিমধ্যে তিনি কোন ছুটিও নেননি বা ঐ ইউনিট থেকে অন্যত্র ট্রান্সফারও হননি।
আর ভবেন্দ্র?
সুবেদার ভবেন্দ্র রায় একজন নন-কমিশন্ড অফিসার-ক্লার্ক। ওর ওখানকার মেসে প্রচুর ধার-দেনা। অত্যধিক মদ্যপান করে। ইতিমধ্যে একদিন নাকি কোন এক ইউনিটের ডিনার খেতে গিয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, সেখানে তার রিভালভারটি খোয়া যায়।
তারপর?
ব্যাপারটার একটা কোর্ট অফ এনকোয়ারি বসেছে।
বাট হোয়াট অ্যাবাউট হিজ রিসেন্ট মুভমেন্ট?
সেটাই বলছি। গত ১৫ই ডিসেম্বর অর্থাৎ এখানকার দুর্ঘটনার দশদিন আগে সে দশদিনের ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নাকি কলকাতায় এসেছে। এবং আজ পর্যন্ত সে ফিরে যায়নি।
ফিরে যায়নি? এখনও কাজে জয়েন করেনি?
না।
অতঃপর সুব্রত মনে হল অন্যমনস্ক ভাবে যেন কি ভাবছে।
মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি ভাবছেন সুব্রতবাবু?
ভাবছি তাহলে ভবেন্দ্র নিশ্চয়ই এখনও কলকাতায়ই আছে, আর—
আর কি?
তার বোন কুন্তলা দেবী নিশ্চয় তার খবর জানে! শুনুন, একটা কাজ অবিলম্বে করতে হবে।
কি, বলুন?
প্লেন ড্রেসে একজন সি. আই. ডি-কে মিঃ রায়ের গড়িয়াহাটার বাড়ির ওয়াচে রাখুন। সে কেবল বাড়িটার প্রতিই নজর রাখবে না, কুন্তলা দেবীর মুভমেন্টসের উপর নজর রাখবে।
বেশ, আমি এখুনিই ফিরে গিয়েই ব্যবস্থা করছি।
আগরপাড়া সলিটারি কর্নারের উপরে নজর রেখেছেন তো?
হ্যাঁ। আজ বিকেল পর্যন্ত খবর হচ্ছে, গত দুদিন বাড়ি থেকে বেরই হননি মিঃ গাঙ্গুলী।
সুব্রত যেন আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সে যেন কি ভাবছে।
আজ তাহলে আমি উঠি সুব্রতবাবু!
আসুন।
অতঃপর মৃণাল সেন বিদায় নেয়।
সুব্রত উঠে গিয়ে ফোনে ভবেন্দ্রকে ডাকল।
ভৃত্য ফোন ধরেছিল। সে বললে, ভবেন্দ্র বাড়িতে নেই।
দিদিমণি নেই?
আছে—তাকে দেবো?
না, থাক।
ভবেন্দ্ৰ কলকাতাতেই আছে। আর এও ঠিক, কুন্তলা জানে সে কোথায়! কিন্তু কেন, ছুটি শেষ হওয়া সত্ত্বেও ভবেন্দ্ৰ কেন এখনও ফিরে গেল না চাকরি স্থলে?
ডেজার্টার হলে আর্মির লোকের কোর্টমার্শাল হয়, শাস্তি হয়, তা কি সে জানে না?
নিশ্চয়ই জানে। তবে ফিরে যায়নি কেন?
কুন্তলা তার ঐ ছোড়দাকে মনে হয় একটু বেশিই ভালবাসে। ঐ ছোড়দার উপরে তার একটা দুর্বলতাও আছে।
কুন্তলা চেহারাটা সুব্রতর মনের পাতায় যেন ভেসে ওঠে।
বিষণ্ণ মুখ। রুক্ষ কেশভার। কপাল ও চোখ দুটি ভারি সুন্দর; যেন কপালের উপরে কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল এসে পড়েছে।
কুন্তলা নামটি ভারি মিষ্টি কিন্তু ডাকতেও ভাল লাগে।
সুব্রত হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। বিরক্ত হয়ে ওঠে নিজের উপরেই। এসব কি ভাবছে সে? আবোল-তাবোল কি এসব চিন্তা সে করছে?
ঘড়ির দিকে তাকাল সুব্রত।
রাত সাড়ে দশটা।
সুব্রত উঠে পড়ল। ভৃত্যকে খাবার দিতে বলল।
.
পরের দিন।
রাত্রি তখন প্রায় দশটা হবে। সেরাত্রেও বাইরে প্রচণ্ড শীত। হাড় পর্যন্ত যেন কাপিয়ে তোলে।
টেলিফোন বেজে উঠল।
সুব্রত টেলিফোন ধরে কার সঙ্গে যেন কথা বলল।
ইয়েস স্যার, একটা মিস্টিরিয়াস লোক পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকেছে পিছন দিক দিয়ে—বোধ হয় পাঁচ-সাত মিনিট হবে!
কিপ এ ক্লোজ ওয়াচ-আমি আসছি। হ্যাঁ, মৃণাল সেনকে খবর দিয়েছ? তাকে ফোন করেছ?
হ্যাঁ স্যার, ফোন করেছিলাম কিন্তু তিনি অফিসে নেই।
সুব্রত টেলিফোন রেখে দিল।
পনেরো থেকে ষোল মিনিটের মধ্যেই সুব্রত ঝড়ের বেগে যেন গাড়ি চালিয়ে গড়িয়াহাটায় মিঃ রায়ের বাড়ির সামনে এসে পড়ল।
কমল নামে যে যুবকটি বাড়ির পাহারায় ছিল সে ছুটে আসে।
এনি ফারদার নিউজ, কমল?
না স্যার।
এখনো বাড়িতেই আছে লোকটা তাহলে?
হ্যাঁ স্যার।
ঠিক আছে। আমি ভিতরে যাচ্ছি। যে পথ দিয়ে ও ভিতরে ঢুকছে সেখানেই তুমি দাঁড়িয়ে থাকো। ও নিশ্চয়ই ঐ পথ দিয়েই ফিরে যাবে। ইউ মাস্ট স্টপ হিম। আর কেউ তোমার সঙ্গে নেই?
না স্যার—তবে এখুনি আমার রিলিফ শিবনাথ আসবে।
ঠিক আছে, আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি থেকো।
ঠিক আছে স্যার।
সুব্রত অতঃপর রাস্তায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেট বন্ধ ছিল।
দারোয়ানকে ডাকতেই সে সাড়া দেয়, কৌন?
দারোয়ানজী, গেট খুলিয়ে!
দারোয়ান এগিয়ে এল। সুব্রতকে সে চিনতে পারে, সাব, আপ!
হ্যাঁ, গেটটা খোল। ছোটবাবু কোঠিমে হ্যায় না?
জী নেহি তো, উননে বাহার গিয়ে।
দারোয়ান গেট খুলে দিল। সুব্রত ভিতরে প্রবেশ করে।
উপরের একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
ভবেন্দ্রর এ সময় থাকার কথা নয়, ব্রত ভাল করেই জানে। সে এ সময়টা তাস খেলতে যায়—তাই গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় কেমন করে?
ড্রইংরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ।
একটু ইতস্তত করে সুব্রত। যেন মুহূর্তকাল কি ভাবে। তারপর বেল বাজায় একবার।
ভিতরে ডিং-ডিং মিউজিক শোনা যায়।
সুব্রত রুদ্ধ নিশ্বাসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এক-একটা সেকেন্ড যেন একএকটা ঘণ্টা বলে মনে হয়।