আব্দুল বলে, সেই রকমই মনে হয় তার—কেউ কাটাই পড়েছেএকেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ ঐ সময় আবার ঘরের মধ্যে টেলিফোন বেজে ওঠে। রসময় তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ফোন ধরে।
সিগন্যাল দেয়ার নির্দেশ এসেছে। রসময় ফোনটা রেখে সিগন্যাল দেবার আদেশ দিয়ে দিল।
সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন ছাড়ল। এখন আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ট্রেন নেই। ট্রেন আসবে—রানাঘাট লোকাল সেই সাতটায়।
কিন্তু আব্দুল কি বলে গেল। কাল রাত্রে নিশ্চয়ই হয়তো কেউ কাটা পড়েছে— অ্যাক্সিডেন্ট—একবার দেখা দরকার।
রসময় ঘর থেকে বের হয়ে প্ল্যাটফরম ধরে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের দিকে এগিয়ে চলল।
কুয়াশা কেটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সূর্যের আলোয় চারিদিক পরিষ্কার।
লাইনের দুপাশে বুনো ঘাস ও ছোট ছোট আগাছাগুলোর উপরে শিশিরবিন্দুগুলো প্রথম সূর্যের আলোয় যেন মুক্তোর মত মনে হয়। টল টল করছে।
ঠিক ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে নয়—তার থেকেও প্রায় একশ গজ দূরে যেখানে রূপশ্রী কটন মিলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটা গুডস্ ট্রেনের লাইন চলে গিয়েছে সেই লাইন ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলে ডাইনে যে ছোট কালভার্টটা-তারই ধারে কি যেন একটা পড়ে আছে রসময়ের নজরে পড়ে।
কালো মত কি যেন একটা মনে হয়।
রসময় সেই দিকে এগিয়ে যায় অতঃপর এবং বস্তুটার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায়-বাঁ দিক দিয়ে হাত দশেক ব্যবধানে মেন লাইন চলে গিয়েছে।
আব্দুল মিথ্যা বলেনি—সে ঠিকই দেখেছে। একটা মানুষের দেহই বটে—তবে তখন আর চিনবার উপায় নেই। মুখটা রক্তাক্ত। ক্ষত-বিক্ষত হাত দুটো ভেঙে দুমড়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
গায়ে একটা কালো গরমের গ্রেট কোট ছিল বোধ হয়—সেটা এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গিয়েছে। সব কিছু জড়িয়ে একটা মাংসপিণ্ড বলেই মনে হয়। পায়ের জুতো দুটো বেশ দামী বলেই মনে হয়—পায়ে মোজাও আছে।
লোকটা যে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয় তা বোঝা যায়। কোন সম্রান্ত শ্রেণীরই লোক। প্রথমেই যেটা মনে হয় রসময়ের ঐ মুহূর্তে, লোকটা সুইসাইড করে নি তো!
কিন্তু সাইড লাইনে এসে সুইসাইড করবে?
ঐ লাইনে তো যখন-তখন ট্রেন চলে না।
মিলের মাল নিয়ে মধ্যে মধ্যে গুডস্ ট্রেন যাতায়াত করে।
.
কিন্তু সুইসাইড হোক বা অন্য কিছু যাই হোক এলাকাটা তারই স্টেশনের অন্তর্গত–অতএব অবিলম্বে তাকে একটা পুলিসে খবর দিতে হবে।
রসময়ের মনের মধ্যে তখন নানা চিন্তা মাকড়সার জাল বুনে চলেছে। রসময় অন্যমনস্ক ভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনে ফিরে এল।
সাড়ে ছয়টা বাজে প্রায়।
থানা খুব বেশি দূর নয়। একটা নোট লিখে তাড়াতাড়ি রসময় স্টেশনের একজন পয়েন্টম্যানের হাতে থানার দারোগা জলধরবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিল।
জলধরবাবু রসময়ের পরিচিত। অফ-ডিউটি থাকলে মধ্যে মধ্যে রসময় জলধরের ওখানে গিয়ে আড্ডা জমায়। চুরি, রাহাজানি, খুন-খারাপির গল্প শোনে বসে।
তবে আগরপাড়ার মত ছোট একটা জায়গায় কি-ই বা এমন চমকপ্রদ ঘটনা যখনতখন ঘটতে পারে।
.
০২.
রাণাঘাট লোকালটা পাস করবার পর জলধরবাবু এসে মাস্টারের ঘরে ঢুকলেন।
কি ব্যাপার ঘোষাল-কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল?
থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যের বয়স হয়েছে—পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। ডিসপেপসিয়ার ক্রনিক রোগীরোগাটে পাকানো চেহারা। মাথার চুল প্রায় পেকে গিয়েছে। ওষ্ঠের উপরে একজোড়া কাঁচাপাকা ভারী গোঁফ।
জলধরের সঙ্গে একজন কনস্টেবলও ছিল, গিরিধারী।
এই যে চাটুয্যে সাহেব আসুন—আমার তো মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট নয়।
তবে কি?
সুইসাইড।
আত্মহত্যা!
হুঁ–কিংবা এ কেস অফ মার্ডারও হতে পারে—রসময় আস্তে বলে।
সে কি মশাই-রেল লাইনের ধারে মার্ডার!
কেন তা কি কখনও হয়নি?
না, না—তা নয়-লোকটা ভদ্রলোক বলে মনে হল নাকি?
ভদ্রলোক তো বটেই, সম্ভ্রান্ত ঘরের বলে মনে হয়।
কোথায়?
চলুন না কালভার্টটার কাছে।
দুজনে এগিয়ে যায়।
রসময় যেন রীতিমত একটা রোমাঞ্চ বোধ করে। তার মনে হয় সে যেন আর স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল নয়—সি. আই. ডি.-র কোন একজন নামকরা অফিসার। একটা হত্যারই ইনভেস্টিগেশনে চলেছে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে রসময় আঙুল তুলে দেখাল, ঐ দেখুন!
মনে হল জলধর চাটুজ্যেও যেন থমকে দাঁড়ালেন সামনের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সামনের দিকে, তারপর সামনে এগিয়ে গেলেন এক পা এক পা করে।
মৃতদেহটা লাইনের এক পাশে পড়ে আছে। একটা বীভৎস লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। লাইনের পাশে পাশে একটা মানুষের সরু পায়ে-চলার পথ। লাইনের উপরে বা পাশে ঠিক নয়, সেই সরু পায়ে-চলার পথের উপর পড়ে আছে দেহটা।
গিরিধারী ওদের পশ্চাতেই ছিল।
সে বলে ওঠে, হায় রাম!
কি চাটুজ্যে সাহেব—কি মনে হয়? ব্যাপারটা রীতিমত সাসপেন্স কিনা?
ঊঁ–
বলছিলাম মৃত্যুটা স্বাভাবিক, মানে একটা আচমকা অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হয় কি?
উঁহু-মনে হচ্ছে না তা-মৃদুকণ্ঠে বলেন জলধর চাটুজ্যে।
সুইসাইডও হতে পারে। কিম্বা—
কি? জলধর তাকালেন রসময়ের মুখের দিকে।
মার্ডারও তো হতে পারে!
জলধর রসময়ের কোন কথার জবাব দিলেন না। আরও একটু এগিয়ে চললেন মৃতদেহটার কাছে।
গায়ের গরম গ্রেট কোটটা দামী ছিল বলে মনে হয়। কোটটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে যেন। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা।