পাঠিয়ে লোক-মারফত পাঠিয়েছে যাতে করে ব্যাপারটা মিঃ রায় মনে করেন জরুরী।
একটু থেমে বলে আবার, দ্বিতীয়ত সে আরও জানত মিঃ রায় রাত্রে আগরপাড়া গেলে তার গাড়িতে যাবেন না—ট্রেনেই যাবেন। তৃতীয়ত হত্যাকারী এমন একটা দিন বেছে নিয়েছিল যেদিন শনিবার, ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভিড় চারটের পর আর থাকবে না–—এবং শীতের সময় ও পরের দিন ছুটি বলে রাস্তায় ঐ সময়টা লোক-চলাচলও বেশি থাকবে না। চতুর্থত সে জানত মিঃ রায়কে রিকশায় করেই দেশবন্ধু কলোনীতে যেতে হবে—হেঁটে অতটা পথ তিনি যাবেন না।
এরপর মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে দেখুন প্রধান জায়গা থেকে আগরপাড়ার কলোনটা বিচ্ছিন্ন। কাজেই ওদিকটা আরও নির্জন হবে। তারপর শনিবার ও শীতের রাত বলে ঐ জায়গাটায় মানুষের চলাচল একপ্রকার ছিল না বললেই চলে সেদিন ঐসময় এবং সেই কারণেই ঐ সময় হত্যাকারীর তাকে গুলি করে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে হত্যা করা খুব একটা ডিফিকাল্ট ব্যাপার কিছু ছিল না।
পঞ্চম : সে ঠিক করেছিল ব্যাপারটাকে একটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় দাঁড় করাতে পারলে সব দিক দিয়েই তার পক্ষে সুবিধা হবে।
একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, তাই সে মিঃ রায়কে হত্যা করবার পর ঐ হুকটার সঙ্গে মিঃ রায়ের গ্রেট কোটটা বিঁধিয়ে ওটা রূপশ্রী কটন মিলের বাইরে যে লোডেড ওয়াগনগুলো ছিল তার একটার সঙ্গে বেঁধে দেয়।
ওয়াগনগুলো তারপর যখন এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়, সেই সময় মৃতদেহ লাইনস্লিপার ও পাথরের ওপর দিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে যায় এবং ঐভাবে হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাওয়ায় হয়ত একসময় দড়িটা ছিঁড়ে লাইনের উপরই পড়ে যায়—যার ফলে মুখটা অমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়-নচেৎ গুলি লেগে ওভাবে থেতলে যেতে পারে না মুখটা অমন করে মৃতদেহের।
ঐভাবে মৃতদেহের মুখটা বিকৃত করার পিছনে হয়ত আরও একটা অভিসন্ধি হত্যাকারীর ছিল। চট করে মৃতদেহ যাতে কেউ আইডেন্টিফাই না করতে পারে এবং সে কারণেই হয়ত ফোলিও ব্যাগটাও দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এত করেও হত্যাকারী দুটো ভুল করেছে-যা স্বাভাবিক ক্ষেত্রে সাধারণত হত্যার ব্যাপারে হয়ে থাকেই–
কি রকম?
প্রথমত হত্যাকারী ঐ টাইপ করা চিঠি পাঠিয়ে এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের জামার পকেট থেকে তার পার্সটা নিতে ভুল করে। পার্সটা না পেলে হয়ত এত সহজে আমরা এতখানি এগুতে পারতাম না, এখনও হয়ত অন্ধকারেই আমাদের ঘুরে ঘুরে মরতে
সুব্রত একটু থেমে আবার বলতে লাগল, এবার দেখা যাক খুনী বা হত্যাকারী এক্ষেত্রে কে হতে পারে! যেভাবে মিঃ রায় নিহত হয়েছেন তাতে মনে হয় হত্যাকারী বাইরের কেউ তার অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। যারা মিঃ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে
পরিচিত ছিল তাদেরই মধ্যে একজন কেউ।
সেকথা বলতে গেলে তো অনেকেই সন্দেহের তালিকায় এসে পড়েন! মৃণাল সেন মৃদুকণ্ঠে বলে।
নিশ্চয়ই। ছোট ভাই সুরেন্দ্র, দুই ছেলে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্র, ম্যানেজার মিঃ মুখার্জী, বন্ধু মিঃ মণীন্দ্র গাঙ্গুলী প্রত্যেকেই। কিন্তু
কি? মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
হত্যাকারীকে বিচার করতে হবে-মোটিভ প্রোবাবলিটি ও চা সব দিক দিয়েই। প্রথম দেখা যাক—প্রোবাবলিটির দিক থেকে কাকে কাকে ওদের মধ্যে সন্দেহ করা যায় বা যেতে পারে।
একটু থেমে সুব্রত বলতে লাগল, মিঃ রায়ের মৃত্যুতে যাদের নাম করলেন ওরা সকলেই জানত ওদের মধ্যে যে কেউই লাভবান হবে। এখন দেখা যাক কে কোথায় হত্যার সময় ছিল—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র অকুস্থান থেকে দুর্ঘটনার সময় অনেক দূরে ছিল–কাজেই তাকে আপাতত বাদ দেওয়া যেতে পারে সন্দেহের তালিকা থেকে, যদিও বাপের সঙ্গে তারও বনিবনা ছিল না, বাপের মৃত্যুতে সে লাভবান হত
দ্বিতীয়ত, ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ। দুর্ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল। বাপের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। বাপকে সে শাসিয়ে যায়—শুধু তাই নয়, সে একজন আর্মির লোক, আর্মির ৩৮ রিভালভারও তার কাছে থাকা সম্ভব। মোটিভ তো তার ছিলই, উপরন্তু চান্সও ছিল প্রচুর।
ছোট ভাই সুরেন্দ্র–
হ্যাঁ, ছোট ভাই সুরেন্দ্র। দুর্ঘটনার রাত্রে সে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। বাড়িতেই ছিল। তারপর এক বন্ধু এসে তাকে তাসের আড্ডায় টেনে নিয়ে যায়। সেখানে রাত দুটো পর্যন্ত তাস খেলেছে। অতএব তার ক্ষেত্রে প্রোবাবলিটি একেবারে nil। মোটিভ থাকলেও চান্সের কথা তো আসেই না
মিঃ গাঙ্গুলী? মৃণাল প্রশ্ন করে এবারে।
হ্যাঁ, মিঃ গাঙ্গুলীর কথাটা বিশেষ করে জানতে হবে—কারণ তাঁর সময়ের এলিবাইটা এখনও প্রমাণ হয়নি—মোটিভ অবশ্য ছিল—চান্স তো খুবই বেশি ছিল।
বিশেষ করে ঐ টাকার ব্যাপারটা–
হ্যাঁ-সেটা আমি ভাবছি। তারপর ধরুন মিঃ মুখার্জ। তিনি প্রথমত উইলের ব্যাপারটা সব জানতেন এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের মৃত্যুতে তিনি বিশেষ ভাবে লাভবান হবেন। সবচাইতে বড় কথা ঐদিনকার মিঃ মুখার্জীর গতিবিধি সম্পর্কেও আমরা সঠিক কোন প্রমাণ যোগাড় করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা জানি না, ঐ বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীই মিঃ রায়ের হত্যাকারী। মৃণাল সেন বলে।