সংবাদটা শুনে সুব্রতর চোখের তারা দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি বলে, যা তাঁকে এখানে এই ঘরে নিয়ে আয়।
সুব্রত গত পরশু আগরপাড়া গিয়ে রসময়বাবুর সঙ্গে আলাপ করে বেশ একটু। ভদ্রলোক সম্পর্কে ইন্টারেস্টই বোধ করেছিল। কৌতুকও ঐসঙ্গে একটু বোধ করেছিল, ভদ্রলোকের মনে ক্রাইম ডিটেকশনের একটা শখ আছে কথায়বার্তায় বুঝতে পেরে।
আপনার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি ডিটেকশনের ব্যাপারে আপনি বেশ ইন্টারেস্টেড। তা আপনি পুলিশ লাইনে গেলেন না কেন বলুন তো? সুব্রত বলেছিল একসময় রসময়কে।
হয়ে উঠল না, বুঝলেন না! রসময় বলেছিল লজ্জার হাসি হেসে।
এ কেসটায় আপনার সাহায্য কিন্তু আমি নেবো।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এ তো আমার গর্বের কথা। বলুন না কি করতে হবে, বলুন?
দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত দেখবেন তো, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তার আশেপাশে কালো রঙের মরক্কো লেদারের একটা ফোলিও ব্যাগ পাওয়া যায় কিনা।
দেখব-নিশ্চয়ই খোঁজ করে দেখব।
আর, ঐদিন মানে দুর্ঘটনার রাত্রে কটন মিল থেকে কোন ওয়াগন গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কিনা—এই খবরটা।
এ আর এমন কি, দিতে পারব খবরটা আপনাকে। গুডস্ ট্রেন সে-রাত্রে গেছে কিনা সে তো আমার ডাইরিতেই আছে। আর কিছু?
হ্যাঁ। ঐ দেশবন্ধু কলোনীতে যে রেস্তোরাঁটা আছে, নাম যার পান্থ-নিবাস, তার অধিকারী ঐ ঋষিবাবুর কাছ থেকে খোঁজ নেবেন সে-রাত্রে সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত কারা কারা সেদিন তার রেস্তোরাঁয় কফি-চা পান করতে গিয়েছিল।
ঋষির সঙ্গে আলাপ আছে। সেও একটি রহস্য-উপন্যাস গল্পের পোকা। মধ্যে মধ্যে সে আমার কাছে বই নিতে আসে, তার কাছেই খবরটা পেয়ে যাব। রসময় তার জবাব দেয়।
সুব্রত বুঝতে পারে, রসময় নিশ্চয়ই কোন খবর সংগ্রহ করে এনেছে, নচেৎ এই শীতের রাত্রে ছুটে আসত না এতদূরে!
রসময় এসে ঢুকল। হাতে একটা ছোট ফোলিও ব্যাগ।
আসুন—আসুন রসময়বাবু, আসুন।
রসময় বসল।
তারপর কি খাবেন বলুন? চা কফি–
না, না। সে-সবের কিছু প্রয়োজন নেই।
বিলক্ষণ, তাই কি হয়! কফিই আনানো যাক।
সুব্রত ভৃত্যকে ডেকে দু কাপ কফির নির্দেশ দিল।
তারপর, এনি নিউজ? কিছু খবর আছে?
আছে।
ফোলিওটা পেয়েছেন নাকি?
নিশ্চয়ই, এই দেখুন।
সুটকেস থেকে একটা কালো মরক্কো লেদারের দামী ফোলিও ব্যাগ রসময় বের করে দিল। ব্যগটা নোংরা হয়ে গিয়েছে।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল সুব্রত ফোলিও ব্যাগটা।
এম. এন. রায় নামটা সোনার জলে মনোগ্রাম করা আছে ফোলিও ব্যাগের গায়ে।
সুব্রত ব্যাগটা খুলে ফেলল।
ব্যাগের ভিতরে কিছু টাকা পাওয়া গেল। নোট-শপাঁচেকের হবে। একশো টাকা ও দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট।
কিছু টাইপ করা কাগজপত্র।
সব কিছু ঘাঁটা—এলোমেলো যেন ভিতরটা।
সুব্রত ব্যাগটা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করে রাখল।
এই ব্যাগটাই খুঁজছিলেন তো স্যার?
হ্যাঁ।
পেলেন?
কি?
যা খুঁজছিলেন? রসময়ের কণ্ঠে আগ্রহ ও উত্তেজনা।
সুব্রত মৃদু হেসে বলে, ব্যাগটাই আমি খুঁজছিলাম রসময়বাবু, অন্য কিছু নয়।
ভৃত্য কফি নিয়ে এল ঐসময়।
কফি পান করবার পর রসময় বলে, সে-রাত্রে এগারোটায় গোয়ালন্দর দিকে একটা গুডস্ ট্রেন গেছে স্যার। এবং সেই ট্রেনে রূপশ্রী কটন মিল থেকে সাতটা ওয়াগন গেছে।
কখন সেগুলো গুডস ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচড় করা হয়?
রাত আটটার পর। একটা ইঞ্জিন গিয়ে মিল ইয়ার্ড থেকে ওয়াগনগুলো টেনে এনে মেল ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচ করে দেয়।
হুঁ, তাহলে ঐ সময়ই–। অন্যমনস্ক ও কতকটা যেন আত্মগতভাবে কথাটা বলে সুব্রত।
কি স্যার?
না, কিছু না।
আরও একটা খবর আছে স্যার।
কি বলুন তো?
সে-রাত্রে সন্ধ্যার সময়, মানে ছটা নাগাদ মিঃ গাঙ্গুলী রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। এবং রাত আটটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।
সত্যি!
হ্যাঁ স্যার, ঋষি বললে। আর একটা জিনিস পেয়েছি স্যার ঐ ব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে রেল লাইনের উপরে।
কি?
রসময় এবারে একটা ইংরাজী এস অক্ষরের মত অনেকটা দেখতে লোহার হুক যা সাধারণত ঘরে ফ্যান টাঙাবার জন্য প্রয়োজন হয়, সঙ্গে একখণ্ড দড়ি-বাঁধা— সুটকেস থেকে বের করল।
দেখুন এটা—দেখুন এতে রক্ত শুকিয়ে আছে।
সুব্রত পরীক্ষা করে দেখল রসময়ের কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যিই দড়িটার গায়ে রক্তের দাগ। সুব্রতর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সে বলে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ রসময়বাবু। এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল, মৃতের চোখ-মুখ-মাথা কেন অমন করে থেতলে গিয়েছে!
.
১২.
পরের দিন সকাল।
মৃণাল সেনকে ফোন করে সুব্রত ডেকে এনেছিল তার বাড়িতে।
দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সামনে কফির পেয়ালা।
সুব্রত বলছিল, এখন তো স্পষ্টই বুঝতে পারছেন মিঃ সেন, সে-রাত্রে ব্যাপারটা কি ঘটেছিল। হত্যাকারী কৌশলে ঐ টাইপ করা চিঠির সাহায্যে মিঃ রায়কে অকুস্থলে টেনে নিয়ে যায় বিশেষ কোন কারণে এবং তারপর তার কাজ হাসিল হওয়ার পর সে তাকে হত্যা করে এবং সমস্ত ব্যাপারটাই পূর্বপরিকল্পিত–
আপনার তাই মনে হয়? মৃণাল সেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ।
সুব্রত অতঃপর বলতে লাগল, প্রথমত হত্যাকারী জানত মিঃ গাঙ্গুলী তার বন্ধু, তাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালে তিনি যাবেনই-তাই সে চিঠি পাঠিয়েছে এবং ডাকে।