নয়ত কি?
একটু পরিষ্কার করে বলুন সুব্রতবাবু, মৃণাল সেন বলে।
ধরুন তার হত্যা করবার ইচ্ছাই যদি থাকত বন্ধুকে কোন কারণে, ঐভাবে তাঁকে তিনি তার এলাকায় ডেকে আনতে যাবেন কেন একটা চিঠি দিয়ে? সেক্ষেত্রে তার উপরেই
যে প্রথম সন্দেহ আসবে সেটা কি তিনি বোঝেননি? না না, ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন। ঠিক তত সহজ নয় হয়ত মিঃ সেন!
মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করেই থাকে।
এন্টালীতে একটা গলির মধ্যে বাড়িটা ডাঃ নলিনী চৌধুরীর। দোতলা বাড়ি। লাল রঙের। পাড়াটা অনেক দিনের পুরানো-বাড়িটাও পুরানো। ঐ বাড়িটাই ভাড়া নিয়ে একসময় ডাঃ নলিনী চৌধুরী তার ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলেছিলেন দোতলায়।
দোতলায় সর্বসমেত চারখানি ঘর। একটা ছোট ঘরে তিনি থাকতেন ও শুতেন–বাদবাকি তিনটে ঘরে তার ল্যাবোরেটারি। একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করা যেত মধ্যবর্তী দরজাপথে।
নলিনী চৌধুরী বিয়ে-থা করেন নি। সংসারে আপনারজন বলতে ছিল ঐ একটিমাত্র ভাগ্নে নীরেন সান্যাল। নীরেনের যখন অল্প বয়েস, বছর আট-দশ, সেই সময় থেকেই নীরেনকে বোনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন ডাঃ চৌধুরী।
নীরেনের মা-বাবাও আপত্তি করেননি—কারণ অনেকগুলি সন্তান, দৈন্যের সংসারে সকলকে মানুষ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। আনন্দেই তাই নীরেনকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কোন একদিন।
নীরেনকে কলকাতায় নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ডাঃ চৌধুরী। তারপর সে ক্রমে পাশ করে এম. এস-সি।
এম. এস-সি. পড়িয়েছিলেন ভাগ্নেকে ডাঃ চৌধুরী ইচ্ছা করেই। তাঁর কেমিস্ট্রিতে একজন সহকারীর প্রয়োজন ছিল।
নীরেনও তার মামাকে হতাশ করেনি। পরে ডক্টরেট পেয়েছিল।
ভাল ভাবেই পাশ করে মামার সঙ্গে তার ল্যাবোরেটারিতে রিসার্চের সাহায্য করতে লাগল। তারপর হঠাৎ একদিন ডাঃ চৌধুরীর হল ক্যানসার এবং তার মৃত্যুর পর
ডাঃ সান্যাল ল্যাবোরেটারি চালাতে লাগলেন।
ডঃ নীরেন সান্যালকে তার ল্যাবোরেটারির মধ্যেই পাওয়া গেল।
বাড়িটা নিচের ঘরগুলোর একটা ড্রইংরুম ও অন্য দুটো স্টোররুম রূপে ব্যবহৃত হয়।
বাকি ঘরটায় ভৃত্য গোপাল থাকে।
ঐ গোপালই নীরেনকে দেখাশোনা করে। রান্না থেকে শুরু করে সব কাজই সে করে।
গোপালকে বলতেই সে বললে, ডাক্তারবাবু ওপরে তার ল্যাবরেটারি ঘরে আছেন। চলে যান।
সুব্রত গোপালের কথাটা শুনে যেন একটু অবাকই হয়।
কারও ল্যাবোরেটারি ঘরে যে অমন সোজা চলে যাবার নির্দেশ মিলতে পারে তার যেন ঠিক ধারণা ছিল না। কিন্তু সে-সম্পর্কে সে কোন কথা বলে না। গোপালের নির্দেশমত মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে সুব্রত সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ির মুখেই একটি ব্যস্ত যুবকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দোতলায়।
হাতে তার একটি তরল পদার্থপূর্ণ টেস্টটিউব।
যুবকটিকেই জিজ্ঞাসা করে সুব্রত, ডাঃ সান্যাল আছেন?
হ্যাঁ আছেন—যান, ঐ পাশের ঘরে যান। হাত দিয়ে ইশারা করে ঘরটা দেখিয়ে দিল যুবক।
ঘরের মধ্যে ঢুকে ওরা দাঁড়াল। ঘরভর্তি সব যন্ত্রপাতি। র্যাকে র্যাকে নানা আকারের শিশিতে নানা রঙের সব ওষুধ। বুনসেন বার্নারে একটা কাচের আধারে কি যেন ফুটছিল।
তার সামনে একটা আরামকেদারায় গা ঢেলে আরাম করে সিগারেট টানছিল একটা যুবক।
বাঙালীদের মধ্যে অমন স্বাস্থ্যবান চেহারা সচরাচর বড় একটা চোখে পড়ে না। লম্বায় খুব বেশি হবে না, কিন্তু নিটোল স্বাস্থ্য।
টকটকে ফর্সা গায়ের রং। যেন ইউরোপীয়দের মত। মাথার চুল ব্যাকব্রাস করা। চোখে চশমা। চোখেমুখে একটা প্রখর বুদ্ধির দীপ্তি আছে। পরনে একটা পায়জামা ও তার উপরে একটা অ্যাপ্রন্।
পদশব্দেই মুখ তুলে তাকিয়েছিল যুবক। এবং তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল এবং পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত মৃণাল সেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?
আমরা ডাঃ সান্যালের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। মৃণাল সেন বলে। আমিই ডাঃ সান্যাল।
ওঃ নমস্কার। আমার নাম মৃণাল সেন। আমি একজন ইন্সপেক্টার, লালবাজার থেকে আসছি আমরা।
লালবাজার থেকে! বলুন তো কি ব্যাপার?
একটু দরকার ছিল আপনার সঙ্গে। ওঃ!
তা বেশ চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। চলুন।
পাশের ঘরটা একটা লাইব্রেরি। চারদিকের আলমারি ও র্যাকে বই ঠাসা। চেয়ার ও টেবিল সেখানে ছিল। মৃণাল সেন ও সুব্রতকে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে নেয় নীরেন।
কি দরকার বলুন তো ইন্সপেক্টার?
কথা বললে সুব্রতই, ডাঃ সান্যাল, আপনি নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে পড়েছেন রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার একটা দুর্ঘটনায় গত শনিবার মারা গেছেন?
আমি জানি।
পেপারেই বুঝি সংবাদটা জানতে পারেন প্রথম?
না। তবে? মহেন্দ্রবাবুর মেয়ে কুন্তলা আমাকে ফোন করে জানায়।
কবে?
সংবাদটা পাবার কিছু পরেই।
কুন্তলা দেবীদের সঙ্গে আপনি অনেকদিন পরিচিত, তাই না ডাঃ সান্যাল?
ওর দাদা সৌরীন্দ্র আমার ক্লাসফ্রেন্ড ও বিশেষ বন্ধু।
আচ্ছা ডাঃ সান্যাল, আপনার মামা ডাঃ চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে তার দুই বন্ধুর নামে, মানে মিঃ রায় ও মিঃ গাঙ্গুলীর নামে, ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি জমা দিয়ে যান—আপনি সে সম্পর্কে কিছু জানেন?
কুন্তলার মুখে একবার শুনেছিলাম বটে চিঠির কথা!
আর কিছু চিঠি সম্পর্কে জানেন না?
না, জানবার প্রয়োজনও বোধ করিনি।