সেদিনকার মত বিদায় নিল ওরা।
দুজনে এসে গাড়িতে উঠে বসল। সুব্রত নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছিল।
মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, কোন দিকে যাচ্ছেন?
এন্টালিতে।
সেখানে?
একবার ডাঃ নীরেন গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা করবেন না?
নীরেন গাঙ্গুলী!
হ্যাঁ-ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ভাগ্নে। আর আর—
নীরেন গাঙ্গুলীর কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন না, কুন্তলা দেবীর মুখের রঙের আভাস!
আপনি তাও নজর করে দেখেছেন? হাসতে হাসতে মৃণাল সেন বলে।
তা দেখতে হয় বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বরাহনগরে যাব মেজর সাহেবের ওখানে।
মেজর সাহেব!
হ্যাঁ, মেজর রণদা সিনহা। এদেশে ফায়ার আর্মসে অতবড় এক্সপার্ট খুব কম পাবেন মিঃ সেন।
অতঃপর সুব্রত মেজর সাহেবের পরিচয় দিল। মেজর রণদা সিনহা গত মহাযুদ্ধে সামান্য সৈনিকের চাকরি নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করে মেজর পদে উন্নীত হন।
বছর সাতেক হল চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন।
রিটায়ার করার পর বরাহনগরে অনেকখানি জায়গাসমেত একটা বাগানবাড়ি কিনে বসবাস করছেন। কোন ঝামেলা নেই সংসারে। স্বামী আর স্ত্রী।
একমাত্র ছেলে, সেও আর্মির চাকরিতে বিদেশে।
একবার একটা কেসে আর্মস-সংক্রান্ত ব্যাপারে ওপিনিয়ানের জন্য কিরীটীর সঙ্গে রণদা সিনহার বরাহনগরের আদি নিবাসে গিয়েছিল। সেই সময়ই আলাপ হয় ওদের। ভারি আমুদে ও রসজ্ঞ লোকটি।
মধ্যে মধ্যে তারপরও সুব্রত ওদিকে গেলে মেজর সিনহার আদি নিবাসে গিয়েছে। আড্ডা দিয়ে এসেছে।
বেশ লম্বা-চওড়া এবং রসিক প্রকৃতির মানুষটি।
ওরা যখন আদি নিবাসে গিয়ে পৌঁছল, মেজর সিনহা তৃতীয়বার চা নিয়ে বসেছিলেন।
মাথায় একমাথা পাকা চুল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
পরনে পায়জামা ও স্লিপিং গাউন।-মুখে একটা মোটা সিগার।
সুব্রতকে দেখে কলস্বরে অভ্যর্থনা জানান সিনহা, আরে সুব্রতচন্দ্র যে-সু-স্বাগতম।
সুব্রত বসতে বসতে বলে, আড্ডা দিতে আজ নয় কিন্তু—
তবে?
একটা ওপিনিয়ন নিতে এসেছি।
কি ব্যাপার?
সুব্রত পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া বুলেট বের করল।
দেখুন তো মেজর সাহেব এই বুলেটটা!
বুলেটটা হাতে নিয়ে একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে সিনহা বললেন, কোথায় পেলেন এটা? এটা তো দেখছি আর্মি রিভলভারের গুলি!
আর কিছু-অন্য বিশেষত্ব আছে বুলেটটার গায়ে?
বিশেষত্ব–দাঁড়ান দেখি। একবার লেন্সটা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাহলে!
বলতে বলতে মেজর উঠে গেলেন ভিতরে এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বুলেটার গায়ে খুব ফাইন খাজ কেটে গেছে। তাতে মনে হয়
কি?
যে রিভলভার থেকে এটা ফায়ার করা হয়েছিল তার গায়ে ভিতরের ঐ ধরনের কোন খাঁজ আছে, যে জন্য ফায়ারের পর বুলেটের গায়ে খাঁজ কেটে গেছে।
আর কিছু নেই তো?
না। কিন্তু এটা পেলেন কোথায়, ব্যাপারটাই বা কি?
একজন নিহত ভদ্রলোকের মাথার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বস্তুটি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোককে সম্ভবত ঐ গুলিটির সাহায্যেই হত্যা করা হয়েছে।
রিয়েলি! কিন্তু যে ধরনের রিভলভারের সাহায্যে ঐ গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল সেই রিভলভার তো কোন আর্মির লোকের কাছে ছাড়া থাকা সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে এই যুদ্ধের সময়!
সেই কারণেই তো আপনার ওপিনিয়নটা নিলাম মেজর। আচ্ছা আজ তাহলে উঠি–অবিশ্যি ব্যালেস্টিক একজামিনেশনের জন্যও পাঠানো হবে বুলেটটা।
উঠবেন?
হ্যাঁ।
বাঃ, তা কি করে হয়? এক কাপ চা অন্তত–
আজ নয় মেজর, অন্য একদিন। আজ একটু তাড়া আছে। সুব্রত বলল উঠতে উঠতে।
কিন্তু এটা ভাল হচ্ছে না রায়সাহেব!
কেন?
কেন কি, রহস্যের দরজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনি বিদায় নিচ্ছেন।
সুব্রত মৃদু হেসে বলে, শীঘ্রই আবার একদিন আসব। চলুন মিঃ সেন।
সুব্রত মৃণাল সেনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
চলন্ত গাড়িতে বসে মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, মহেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে যে বুলেটটা পাওয়া গিয়েছিল ওটা সেই বুলেটটাই তো?
সুব্রত সামনের দিকে চেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, মৃদুকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ।
সুব্রতবাবু, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে—
কি?
মিঃ গাঙ্গুলী সন্দেহের তালিকায় একেবারে শীর্ষস্থানে!
কেন?
আপনি যাই বলুন প্রথমত সিঙ্গাপুরে ছিলেন—যুদ্ধের সময় কোনমতে পালিয়ে এসেছেন। তার পক্ষে অবশ্যই একটা ৩৮ আর্মি রিভালভার সংগ্রহ করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। শুধু তাই নয়, মোটিভ যদি ধরেন তো চল্লিশ হাজার টাকা যেটা তিনি তার বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছিলেন—এক্ষেত্রে ধারই বলব কারণ ডিডে যখন শোধ করবার একটা কথা আছে
তারপর? বলুন, থামলেন কেন?
ঐ ডাঃ চৌধুরীর চিঠিটা। ওটাকে আমি একেবারে কিছু না বলে উড়িয়ে দিতে যেন কিছুতেই পারছি না। আমার কেন যেন ধারণা
কি?
ঐ চিঠির মধ্যে কোন একটা রহস্য আছে, যে রহস্যটা হয়ত ভদ্রলোক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বা চিঠিটার কোন সমাধানের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বন্ধুকে কৌশলে একটা টাইপ করা চিঠি দিয়ে ডেকে এনে সে-রাত্রে হত্যা করেছেন।
অসম্ভব কিছুই নয়, কিন্তু—
কি?
একটা কথা কিন্তু ভাববার আছে এর মধ্যে। মিঃ গাঙ্গুলী মানুষটা যে বোকা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না। সেক্ষেত্রে তিনি অমনভাবে একটা কাচা কাজ করবেন, ব্যাপারটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
কাচা কাজ কেন বলছেন সুব্রতবাবু?