আর কোম্পানির স্বত্বের অর্ধেক দিয়ে গিয়েছেন কুন্তলাকে, অর্ধেক মিঃ মুখার্জীকে।
দুই ছেলে কোম্পানি থেকে দেড় হাজার টাকা করে মাসোহারা পাবে মাত্র। তাদের আর কিছু দেননি।
কোম্পানির আয় বাৎসরিক চার লক্ষ টাকার মত।
মিঃ রায়ের সম্পত্তির পরিমাণ শুনে সুব্রত সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ঐ সঙ্গে আর একটা কথা জানা গিয়েছে। ঐ শেষোক্ত উইলটি মৃত্যুর মাত্র দুমাস আগে করেছিলেন নাকি মহেন্দ্র রায় আগের উইলের বদলে।
আগের উইলে-মেয়েকে অর্ধেক দিয়ে বাদবাকি নগদ টাকা দুই ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
বাড়িটার অবিশ্যি আগের উইলের মতই ব্যবস্থা ছিল—আর কোম্পানির অর্ধেক ছিল মিঃ মুখার্জীর ও বাদবাকি অর্ধেক তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করা ছিল।
সে সম্পর্কেই আলোচনা চলছিল মিঃ মুখার্জীর বসবার ঘরে।
আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, আপনি যখন উইলের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, আপনি হয়ত জানেন কেন হঠাৎ তিনি তাঁর উইলটা আবার বদলেছিলেন? সুব্রত প্রশ্ন করে।
ঠিক বলতে পারব না, তবে–
কি?
মনে হয়, হয়ত ছেলেদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি উইলটা বদলেছিলেন।
কেন, বাপ-ছেলেদের মধ্যে কি তেমন সম্প্রীতি ছিল না?
না। কোনদিনই তেমন প্রীতির সম্পর্ক ছিল না বাপ ও ছেলেদের মধ্যে।
কেন—কোন কারণ ছিল কি বাপ ও ছেলেদের মধ্যে সম্প্রীতি না থাকার?
আমার মনে হয় কারণ একটা হয়ত ছিল—
কি?
স্যারের একটা আনম্যারেড শালী ছিল—
ছিল কেন বলছেন?
গত বছর তিনি একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।
অ্যাক্সিডেন্ট!
হ্যাঁ, বাড়ির বাথরুমের সুইচে ইলেকট্রিক কারেন্টের শক খেয়ে মারা যান। ঐ শালীর সঙ্গে স্যারের ঘনিষ্ঠতা ব্যাপারটা তার স্ত্রীর মৃত্যুর বছরখানেক আগে থাকতেই নাকি গড়ে উঠেছিল। এবং মৃত্যুর পর বেশি হয়।
মিঃ রায়ের ঐ শ্যালিকা কি তার বালিগঞ্জের বাড়িতেই থাকতেন?
না—তিনি থাকতেন শ্যামবাজারে একটা বাড়ি নিয়ে। শ্যামবাজারের একটা স্কুলের তিনি হেডমিস্ট্রেস ছিলেন।
হুঁ। আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের ছেলেদের রিসেন্ট কোন খবর জানেন?
বড় সৌরীন্দ্রর কোন সংবাদ জানি না, তবে ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ ঐ দুর্ঘটনার দিনসাতেক আগে এক দ্বিপ্রহরে তার বাবার সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এসেছিল।
অফিসে?
হ্যাঁ। আমার আর মিঃ রায়ের অফিস কামরা পাশাপাশি। আমি হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শুনে ব্যাপারটা কি জানবার জন্য স্যারের অফিসঘরের দিকে যাই। সেই সময় দড়াম করে দরজা খুলে ভবেন্দ্র মিঃ রায়কে শাসাতে শাসাতে রাগতভাবে বের হয়ে গেল দেখলাম।
শাসাতে শাসাতে বের হয়ে গেলেন!
হ্যাঁ, ভবেন্দ্ৰ বলছিল, ওল্ড ভালচার-বুড়ো শকুনি, তোমাকে আমিও দেখে নোব।
তারপর?
আমি স্যারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। দেখি তিনিও অত্যন্ত উত্তেজিত-বলছেন, রাস্কেল! তারপর আমাকে দেখে বললেন, আর কখনও যেন ও আমার অফিসে না ঢুকতে পারে! দারোয়ানদের স্ট্রিট অর্ডার দিয়ে দেবে মুখার্জী।
অতঃপর সুব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি মিঃ রায়ের অফিসে কতদিন কাজ করছেন—মানে বর্তমান পোস্টে?
প্রায় বছর দশেক হবে।
তার আগে?
তার আগেও তার কোলিয়ারিগুলো দেখাশোনা করতাম আমি।
.
১০.
কিছু মনে করবেন না মিঃ মুখার্জী—উইলে আপনাকে মিঃ রায় অনেক কিছু দিয়েছেন
শুনলাম! সুব্রত বলে।
মিঃ মুখার্জী বললেন, মিঃ রায় মানে মহেন্দ্র রায়ের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে।
সম্পর্ক!
হ্যাঁ। আমরা মামাতো-পিসতুতো ভাই। আমার মা অর্থাৎ ওঁর পিসিমার কাছেই মিঃ রায় মানুষ হয়েছিলেন। কারণ ওঁর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর সেই সময় আমার মামীমা–মহেন্দ্র রায়ের মা মারা যান। উনি তাই বলতেন পিসিমার ঋণ নাকি উনি জীবনে শোধ করতে পারবেন না।
আপনি যে মিঃ রায়ের আত্মীয় কথাটা কিন্তু সেদিন বলেননি। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।
না, বলিনি। দেখুন সুব্রতবাবু, বড়লোকের আত্মীয়তা ঘোষণা করবার মধ্যে গৌরব অনুভব করা একটা থাকতে পারে, কিন্তু মর্যাদা নেই হয়ত।
সুব্রত মিঃ মুখার্জীর কথা শুনে একবার তার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু সে বলবার আগেই মিঃ মুখার্জী পুনরায় বললেন, আমাদের পরস্পরের মধ্যে বর্তমানের অবস্থার এমন এক আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে গিয়েছিল যে, কেউ হয়ত অতীতের সে সম্পর্কের কথাটা কখনও মনে করতাম না পরবর্তীকালে।
সুব্রত ঐ সম্পর্কে আর কোন আলোচনা করল না–সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বললে, মিঃ মুখার্জী, আপনি সেদিন বলেছিলেন মিঃ গাঙ্গুলী এদেশে ফিরে এসে তার বন্ধু মিঃ রায়ের কাছ থেকেই অর্থসাহায্য নিয়ে আগরপাড়ায় বাড়ি করেছিলেন।
হ্যাঁ!
টাকার পরিমাণটা হয়ত আপনি জানেন–
জানি। হাজার চল্লিশ হবে।
আচ্ছা কি শর্তে মিঃ রায় তার বন্ধুকে টাকাটা দিয়েছিলেন।
বিশেষ কোন শর্তই ছিল না।
মানে? যখন সুবিধা হবে টাকাটা দেবেন এই আর কি!
কিন্তু একজন যিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে পৌঁচেছেন, যাঁর সর্বস্ব গেছে, তার পক্ষে আর এত টাকা শোধ করার সম্ভাবনা কোথায়?
মিঃ মুখার্জী চুপ করে থাকেন।
অবিশ্যি যদি আর কোন কারণ থেকে থাকে—
থাকলেও আমি জানি না। হুঁ। আচ্ছা কোন ডিড হয়নি লেনদেনের? হয়েছিল।
সে ডিডটা একবার দেখতে পারি?
কাল অফিসে আসবেন, দেখাব।
অফিসে আছে বুঝি?
না। মিঃ রায়ের বাড়িতেই আছে। কাল আনিয়ে রাখব সেখান থেকে।