বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম যাকে বলে। মুখখানি কিন্তু ভারি সুন্দর—বিশেষ করে ছোট কপাল-টানা জ্ব-নাক ও চিবুক। সব কিছুর মধ্যে এমন চমৎকার একটা সামঞ্জস্য আছে যাতে করে সমগ্র
মুখখানিকে অপূর্ব একটি লাবণ্য দিয়েছে।
মাথায় বেশ দীর্ঘ কেশ। তৈলহীন রুক্ষ। পরনে সাধারণ একখানা কালোপাড় শাড়ি। গায়ে সাদা ব্লাউজ। হাতে একগাছি করে সোনার বালা। পায়ে চপ্পল।
সুব্রতই আহ্বান জানায়। বলে বসুন মিস রায়। কু
ন্তলা একটা সোফায় বসল ওদের মুখোমুখি।
সুব্রতই কথা বলে, আপনার এই বিপদের সময় আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত ও লজ্জিত। কিন্তু বুঝতেই পারছেন—উপায় নেই বলেই
কুন্তলা কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
কয়েকটা কথা আমাদের জানবার ছিল মিস্ রায়!
কুন্তলা সুব্রতর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
গত শনিবার কোন সময় আপনার বাবা অফিস থেকে ফিরে আসেন?
বোধ হয় সাড়ে চারটে হবে।
কখন আবার বের হয়ে যান?
পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি ছিলেন না। এসেই বের হয়ে যান—চা ও খাননি।
কোথায় যাচ্ছেন কি বৃত্তান্ত এসব সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার কোন কথাবার্তা হয়েছিল?
হ্যাঁ, বলেছিলেন আগরপাড়ায় মণীন্দ্র কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। পরের দিন সকালে ফিরবেন এবং দেরি হলে সোজা অফিসেই চলে যাবেন।
কেন যাচ্ছেন আগরপাড়া সে-সম্পর্কে কিছু বলেননি?
না।
আচ্ছা কুন্তলা দেবী, শুনেছি আপনাদের মা মারা যাবার পর আপনি আপনার মামাদের ওখানে চলে যান।
হ্যাঁ-আমি, দাদা, ছোড়দা—তিনজনেই গিয়ে থাকি।
তাহলে আপনারা দীর্ঘদিন মামার বাড়িতেই কাটিয়েছেন।
হ্যাঁ। বছর দুই হল বি. এ. পাস করবার পর মামীমা মারা গেলেন। তখন বাবা বললেন এখানে চলে আসতে-মামীমার শ্রাদ্ধ চুকে গেলে বাবা গিয়ে সঙ্গে করেই আমাকে নিয়ে আসেন, সেই থেকে বাবার কাছেই আছি।
আর আপনার দাদারা?
দাদা ইন্টারমিডিয়েট পাস করবার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। তখন থেকে সে হস্টেলেই ছিল আর ছোটদাও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মামার বাড়িতে ছিল। তারপর এই বাড়িতে চলে আসে।
আপনারা যখন মামার বাড়িতে ছিলেন, মিঃ রায় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন না বা আপনারা এখানে মধ্যে মধ্যে আসতেন না?
বাবাই মধ্যে মধ্যে যেতেন। আমরা কখনও আসিনি। তবে এখানে চলে আসবার বছরখানেক আগে থাকতে বাবা মধ্যে মধ্যে আমাকে গাড়ি পাঠিয়ে এখানে নিয়ে আসতেন। পাঁচ-সাতদিন এখানে আমি থেকে আবার ফিরে যেতাম।
আপনাদের বাবা আপনাদের মধ্যে সবচাইতে কাকে বেশি ভালোবাসতেন বলে মনে হয় আপনার?
বাবা তার সন্তানদের কাউকেই কম ভালবাসতেন না। তবে অত্যন্ত চাপা ও গম্ভীর। প্রকৃতির মানুষ বলে কিছু প্রকাশ পেত না।
হুঁ। আচ্ছা আপনার বাবার বন্ধু ডাঃ নলিনী চৌধুরীকে আপনি চিনতেন?
হ্যাঁ, নলিনী কাকা তো প্রায়ই মামার বাড়িতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।
আপনাদের ঐ নলিনী কাকা আপনার বাবা ও মণীন্দ্র কাকার নামে মৃত্যুর পূর্বে ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন, আপনি সে-চিঠি সম্পর্কে জানেন কিছু?
শুনেছিলাম—তবে সে চিঠি কিসের—কি তাতে লেখা ছিল জানি না।
চিঠির কথাটা শুনেছিলেন কার কাছে?
বাবার কাছেও শুনেছি, আর—
আর কার কাছে শুনেছেন?
নীরেনের কাছেও শুনেছি।
নীরেন!
ডাঃ নীরেন সান্যাল দাদার বন্ধু। নলিনী কাকার ভাগ্নে।
সুব্রত লক্ষ্য করল নীরেনের কথা বলবার সময় কুন্তলার মুখটা যেন একটু রাঙা হয়ে উঠল। সে চোখ নামাল।
সুব্রত এবার প্রশ্ন করে, ডাঃ নীরেন সান্যালের সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
দাদার সঙ্গে প্রায়ই মামার বাড়িতে আসত-সেখানেই অনেকদিনের পরিচয়।
আচ্ছা মিস রায়, যাবার সময় আপনার বাবার হাতে কিছু ছিল, আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, তার ফোলিওটা ছিল।
কেমন দেখতে সেটা?
কালো রঙের মরক্কো লেদারের তৈরি। উপরে বাবার নাম মনোগ্রাম করা সোনার জলে।
ভাল কথা, আপনার যে দাদা আর্মিতে কাজ করেন, এখন কোথায় আছেন জানেন?
শুনেছি ইস্টার্ন ফ্রন্টে। তবে কোথায় জানি না।
শেষ কবে ছুটিতে আসেন?
মাস আষ্টেক আগে।
আপনার ছোড়দা?
একটু যেন ইতস্তত করল কুন্তলা, তার পর মৃদুকণ্ঠে বললে, ছোড়দা এখন বেরিলিতে পোস্টেড্।
আর একটা কথা—আপনার বাবার উইল সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?
না। মাত্র গতকালই আমাদের সলিসিটার এসেছিলেন। তার কাছে শুনলাম বাবার উইল আছে। আগামী কাল সেই উইল পড়ে শোনাবেন তিনি বলে গেছে।
আচ্ছা আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি যেতে পারেন।
কুন্তলা উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল মহেন্দ্র রায়ের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে।
.
দিন দুই পরে।
মিঃ মুখার্জী-রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজারের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।
সুব্রত, মৃণাল সেন ও মিঃ মুখার্জী কথা বলছিল।
গতকাল সন্ধ্যায় উইল পড়া হয়ে গিয়েছে।
মহেন্দ্র রায় তার ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটের চার লক্ষ টাকার মধ্যে এক লক্ষ টাকা তার মেয়ে কুন্তলাকে—নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাই সুরেন্দ্রকে ও বালিগঞ্জের বাড়িতে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে তাদের থাকবার অধিকার দিয়ে গিয়েছেন।
বাকি দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা নানা প্রতিষ্ঠানে দান করে গিয়েছেন। এবং কুন্তলা ও সুরেন্দ্রর অবর্তমানে বাড়িটাও রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে গিয়েছেন অবলা বিধবাদের একটা আশ্রম করবার জন্য।